মিথ্যা তথ্য দিয়ে প্রথমে জাল এনআইডি ও টিআইএন নম্বর তৈরি করে চক্রটি। এসব জাল এনআইডি ও টিআইএন নম্বর দিয়ে রেজিস্ট্রি অফিসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশে তৈরি করা হয় ফ্ল্যাটের ভুয়া দলিল। পরে ওই দলিল বিভিন্ন ব্যাংকে মর্টগেজ রেখে মোটা অঙ্কের টাকা ঋণ নেয়। চক্রটি এখন পর্যন্ত একাধিক ব্যাংক থেকে ৫০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে।
শুক্রবার রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে এই দলিল জালিয়াতি চক্রের সাতজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। এর আগে চক্রের মাস্টারমাইন্ড জয়নাল আবেদীন ওরফে ইদ্রিসকে গ্রেফতার করে সংস্থাটির ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিট। গ্রেফতার হওয়া অন্যরা হলো- ইদ্রিসের প্রধান সহযোগী রাকিব হোসেন (৩৩), ইদ্রিসের ভায়রা ভাই কে এম মোস্তাফিজুর রহমান (৫৪), জাল কাগজপত্র ও এনআইডি প্রস্তুতকারক লিটন মাহমুদ (৪০), ভূমি রেজিস্ট্রি অফিসের দলিল প্রস্তুতকারক হাবিবুর রহমান মিঠু (৩০), এনআরবিসি ব্যাংক কর্মকর্তা হিরু মোল্যা (৪৪), আবদুস সাত্তার (৫৪) ও সৈয়দ তারেক আলী (৫৪)। তাদের কাছ থেকে প্রতারণার কাজে ব্যবহৃত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সিলমোহর, একই ব্যক্তির একাধিক এনআইডি ও টিআইএন নম্বর, ব্যক্তিগত মোবাইল ফোন, বিভিন্ন ব্যাংকের ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ডসহ নগদ ৩ লাখ টাকা জব্দ করা হয়। গতকাল মালিবাগে সিআইডির প্রধান কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান সংস্থাটির প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি মোহাম্মদ আলী মিয়া। তিনি বলেন, সম্প্রতি সিআইডির ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিট গোপন সূত্রে জানতে পারে- একটি সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্র জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন পরিদফতরের কিছু অসাধু সদস্যদের সহযোগিতায় চক্রের সদস্যদের নামে একাধিক এনআইডি ও টিআইএন তৈরি করছে।
পরবর্তীতে এই এনআইডি ও টিআইএন ব্যবহার করে চক্রের সদস্যরা ভূমি রেজিস্ট্রি অফিসের অসাধু লোকদের মাধ্যমে চক্রের সদস্যদের নামে ফ্ল্যাট কিংবা জমির একাধিক মূল দলিল তৈরি করত। পরে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজশে এসব জাল দলিল দিয়ে দেশের বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে মর্টগেজ রেখে একটি ফ্ল্যাটের বিপরীতে একাধিক লোন গ্রহণের মাধ্যমে প্রায় ৫০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে। মোহাম্মদ আলী মিয়া বলেন, দীর্ঘ অনুসন্ধানে জানা যায়- এ সংঘবদ্ধ অপরাধ চক্রের হোতা জয়নাল আবেদীন ইদ্রিস। তার সংঘবদ্ধ অপরাধ চক্রের সদস্যরা ঢাকার বিভিন্ন অভিজাত এলাকায় বিলাসবহুল ফ্ল্যাটের ক্রেতা হিসেবে হাজির হন। ফ্ল্যাট কেনার জন্য শুরুতে মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে ফ্ল্যাট বায়না করেন। এরপর ফ্ল্যাটের মালিকানার তথ্য যাচাইয়ের কথা বলে মালিকের কাছ থেকে দলিল এবং অন্যান্য কাগজপত্রের কপি সংগ্রহ করেন। ফ্ল্যাটের মালিকের কাছ থেকে নেওয়া দলিল এবং অন্যান্য কাগজপত্রের তথ্য নিয়ে ভূমি রেজিস্ট্রি অফিসের অসাধু লোকদের মাধ্যমে তৈরি করেন জাল দলিল। জয়নাল আবেদীন ইদ্রিস জাল দলিলে কখনো নিজে মালিক হন, আবার কখনো চক্রের অন্যান্য সদস্যদের মালিক বানান।
এরপর সেই জাল দলিল দিয়ে পাতেন ফ্ল্যাট বিক্রির ফাঁদ। ফ্ল্যাট পছন্দ হলে ক্রেতার কাছ থেকে বায়না বাবদ অগ্রিম টাকাও নেন জয়নাল। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কতিপয় কর্মকর্তাদের যোগসাজশে জাল দলিল দেখিয়ে ক্রেতার নামে ব্যাংক ঋণ নিয়ে সেই টাকাও আত্মসাৎ করে। সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, জয়নাল আবেদীন ইদ্রিসের নেতৃত্বাধীন এ ফ্ল্যাট জালিয়াতি চক্র ঢাকার বিভিন্ন অভিজাত এলাকায় ফ্ল্যাট বিক্রির ফাঁদ পেতে জাল দলিলের মাধ্যমে পথে বসিয়েছে বহু ফ্ল্যাট মালিককে। পাশাপাশি সম্ভাব্য ফ্ল্যাট ক্রেতাদের কাছ থেকে ফ্ল্যাট বিক্রির অগ্রিম টাকা এবং ব্যাংক ঋণের বোঝা চাপিয়ে তাদের করেছে নিঃস্ব। সিআইডির অনুসন্ধানে ফ্ল্যাট জালিয়াতির মাধ্যমে অবৈধভাবে বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগের সত্যতা পেয়ে জয়নাল আবেদীন ইদ্রিসের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান রুমানা জুয়েলার্স, নীড় এস্টেট প্রোপার্টিস লিমিটেড, স্নেহা এন্টারপ্রাইজ, ই আর ইন্টারন্যাশনালসহ চক্রের ২৫ জন সদস্যের বিরুদ্ধে ডিএমপির উত্তরা-পূর্ব থানায় মানিলন্ডারিং আইনে মামলা করে সিআইডি।
সিআইডি প্রধান বলেন, এ চক্রের মাস্টারমাইন্ড জয়নাল আবেদীন ইদ্রিস রাজধানীর মিরপুরে কো-অপারেটিভ মার্কেটের একটি স্বর্ণের দোকানের কর্মচারী ছিলেন। পরবর্তীতে জয়নাল আবেদীন ও শহিদুল ইসলাম সবুজ মিলে ফ্ল্যাট জালিয়াতি শুরু করেন। এ চক্রের সঙ্গে জড়িত হয়ে শত কোটি টাকার মালিক বনে যান জয়নাল। তার অন্যতম প্রধান সহযোগী দুই স্ত্রী রোমানা সিদ্দিক ও রাবেয়া আক্তার মুক্তা। প্রতারণার জন্য নিজ নামে ছয়টি সক্রিয় এনআইডি ব্যবহার করেন। এসব এনআইডি দিয়ে বিভিন্ন ব্যাংকে ৫০টির অধিক হিসাব খোলেন। জয়নাল ফ্ল্যাটের মালিকানার দলিলের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে হাতিয়ে নিয়েছে কোটি কোটি টাকা। এ অবৈধ অর্থে রাজধানীর ভাটারা এলাকায় সাত তলা বাড়ি, তিনটি ফ্ল্যাট, মিরপুর ও আশকোনায় তিনটি ফ্ল্যাট কেনেন।