শিগগিরই ব্যাংকঋণের সুদহারের সীমা তুলে নিয়ে বাজারভিত্তিক করা হবে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। তিনি বলেন, ‘সুদহারের সীমা তুলে নেওয়া হবে। ব্যাংকগুলো চাহিদা ও জোগানের ভিত্তিতে ব্যাংকঋণের সুদহার ঠিক করবে। ঋণ সুদে কোনো বিধি-নিষেধ থাকবে না।
’ তবে কবে নাগাদ ঋণ সুদহারের বর্তমান সীমা তুলে নেওয়া হবে তা সুনির্দিষ্ট করে বলেননি গভর্নর।
গতকাল রবিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগ ও বণিক বার্তার যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত আন্তর্জাতিক সেমিনারে আব্দুর রউফ তালুকদার এসব কথা বলেন।
রাজধানীর সোনারগাঁ হোটেলে আয়োজিত প্রথম ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্সে ‘ফিসক্যাল অ্যান্ড মনিটরি পলিসি ইন দ্য ইভলভিং ইকোনমিক অর্ডার’ সেশনে তিনি এসব কথা বলেন। এই সেশনে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ, সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান, সাবেক গভর্নর ফজলে কবীর, অর্থ মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব ড. এম তারেক ও সাবেক সচিব মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী।
সুদহার নির্ধারণে বাংলাদেশ ব্যাংক এখন একটি নতুন পদ্ধতি অনুসরণ করছে। এর ফলে ঋণের সুদ প্রতি মাসেই বাড়ছে। গত ফেব্রুয়ারিতে ব্যাংকে ঋণের সর্বোচ্চ সুদ ছিল ১২.৪৩ শতাংশ। মার্চে তা বেড়ে হয় ১৩.১১ শতাংশ।
বিনিময়হারের বিষয়ে গভর্নর বলেন, ‘এ ক্ষেত্রে কিছুটা প্রতিকূলতা আছে। অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থা হিসেবে আমরা ক্রলিং পেগ পদ্ধতি চালু করতে যাচ্ছি। পরে এটিও বাজারভিত্তিক করে দেওয়া হবে। মুদ্রানীতি প্রণয়ন কমিটিতে আগে অভ্যন্তরীণ কর্মকর্তারা থাকলেও বর্তমানে আমরা বাইরের বিশেষজ্ঞদেরও এখানে অন্তর্ভুক্ত করেছি।’
ভর্তুকির বন্ড ইস্যুর মাধ্যমে বাজারে অর্থের সরবরাহ বাড়ার বিষয়ে তিনি বলেন, বন্ড থেকে এক লাখ কোটি টাকা তৈরি হয়েছে বলে একজন আলোচক উল্লেখ করেছেন।
কিন্তু টাকা তৈরির বিষয়টি এতটা দ্রুততার সঙ্গে হয় না। বন্ডের মাধ্যমে অর্থের সরবরাহ বাড়ার জন্য কয়েক বছর সময় লাগে। সার ও বিদ্যুৎ খাতের বন্ড ইস্যুর জন্য মুদ্রা সরবরাহ পাঁচ গুণ বেড়েছে তা ঠিক না।
সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে মুদ্রানীতির চেয়ে সরকারের ব্যর্থতা বেশি। মন্ত্রণালয়গুলোর একেক রকম ঘোষণায় বাজারের সরবরাহ ব্যবস্থা প্রভাবিত হয়েছে। মুদ্রানীতির কার্যকর ফল পেতে বাংলাদেশকে নীতিগত বিষয়ে শক্ত অবস্থানে থাকার পরামর্শ দিয়ে সাবেক এই গভর্নর বলেন, ‘কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসন তো দেওয়া আছে। সব কিছু পুরো দিয়ে দেওয়া হয় না, অর্জন করতে হয়। বাংলাদেশ ব্যাংককে তা এখন অর্জন করতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘ব্যাংকিং খাতে সরকারসহ সব সময় প্রভাবশালী গোষ্ঠী প্রভাব বিস্তার করবেই। রাজনৈতিক প্রভাব থেকে বের হওয়া যায় না। যতটুকু সহনশীল করা যায়, তা মানা। এটি কেন্দ্রীয় ব্যাংক করতে পারে নিজের অবস্থান ধরে রেখে। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সেই সক্ষমতা আছে বলে মনে করি। এখন দরকার তা মেনে চলা।’
মূল্যস্ফীতির তাপ মানুষের গায়ে লাগছে মন্তব্য করে সাবেক গভর্নর আতিউর রহমান বলেন, ‘বাজারে গেলে শরীরে মূল্যস্ফীতির তাপ লাগে। যাঁরা বাজারে যান তাঁরা বুঝতে পারেন। যেভাবেই হোক মূল্যস্ফীতি একটু কমাতে হবে।’
তাঁর কথার সমর্থনে সাবেক গভর্নর ফজলে কবির বলেন, ‘মূল্যস্ফীতির আঘাত সবচেয়ে বেশি লাগে দরিদ্র ও নির্ধারিত আয়ের মানুষের। মূল্যস্ফীতি কারো জন্যই ভালো না। এটি ব্যবসায়ীদের জন্য ভালো না।’
সাবেক সচিব মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী বলেন, ‘এভাবে ২০ হাজার কোটি টাকার সরকারের বন্ড বাজারে এক লাখ কোটি টাকার কাজ করছে। এটিও টাকা ছাপানোর মতো। এভাবে টাকা ছাপিয়ে সরকারকে ঋণ দিলে মূল্যস্ফীতি কিভাবে কমবে’, প্রশ্ন রাখেন তিনি।
এর উত্তরে আব্দুর রউফ তালুকদার বলেন, গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক টাকা ছাপিয়ে সরকারকে ঋণ দিচ্ছে না। বাণিজ্যিক ব্যাংক ঋণ দিচ্ছে। আর বন্ড ছাড়া মানে টাকা ছাপানো কি না তা গবেষণার দাবি রাখে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব মোহাম্মদ তারেক বলেন, ‘জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সক্ষমতা বাড়াতে হবে। নইলে আগামী বাজেটেও সরকারকে বেশির ভাগ অর্থ ধার করতে হবে।’
সকালে এই সম্মেলনের উদ্বোধনী অধিবেশনে প্রধান অতিথি জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী বলেন, ‘বিবর্তিত বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে উন্নয়নের পন্থাগুলো নিয়ে সবাই শঙ্কিত। দ্রুত বৈশ্বিক পরিস্থিতি পরিবর্তন হচ্ছে। সে বিষয়গুলোর সঙ্গে খাপ খাওয়াতে চেষ্টা করছে সব দেশ। উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য সেটা অনেক চ্যালেঞ্জিং। এর মধ্যে বাংলাদেশ ভালো অবস্থায় রয়েছে। কিছু চ্যালেঞ্জ আছে, আমরা সে জন্য উত্তম পলিসি নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি। যখন এই বাংলাদেশ শুরু হয়েছে তখন ব্যাংকে টাকা ছিল না, খাবার ছিল না। সেই দেশ দ্রুত সময়ে সোনার বাংলা হয়েছে। অল্প সময়ে বঙ্গবন্ধু সেই উন্নয়ন পলিসির সূচনা করেছিলেন।’
সম্মেলনে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে অর্থ প্রতিমন্ত্রী ওয়াসিকা আয়শা খান বলেন, ‘বাংলাদেশ সফলভাবে ডিজিটাল বাংলাদেশ হওয়ার পরে এখন স্মার্ট বাংলাদেশের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এসডিজি অর্জনে আমাদের বর্তমান অবস্থা খুব ভালো। আমরা আগামী প্রজন্মের জন্য আরো শক্তিশালী অর্থনীতি গড়ে তোলার জন্য কাজ করছি।’
সকালের অধিবেশনে অর্থনীতিবিদ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, ‘রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পরে আমেরিকা ও চীনের যে বাণিজ্য যুদ্ধ শুরু হয়েছে, সেটা উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য ক্ষতিকর হয়েছে। আবার কিছু ক্ষেত্রে বড় বড় আমেরিকার কম্পানি চীন থেকে ব্যবসা ভিয়েতনামের মতো দেশে সরিয়ে নিয়েছে। তবে এমন ক্ষেত্রে বাংলাদেশ তেমন কোনো সুবিধা নিতে পেরেনি। যেটা আমাদের একটা সুযোগ ছিল।’
বাংলাদেশ ও ভিয়েতনাম একই ধরনের অর্থনীতির দেশ ছিল। কিন্তু এখন তারা অনেক এগিয়ে গেছে জনবান্ধব ও ব্যবসাবান্ধব পলিসির জন্য।
তিনি বলেন, সরকারের যদি জনসমর্থন ঠিক থাকে তাহলে দেশের বৈদেশিক স্বার্থরক্ষা সহজ হয়। দেশের ভেতরে রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশের জন্য দেশের স্বার্থ নিয়ে কোনো আপস করতে হয় না।