এক সময় শিল্পায়নসহ দেশের অর্থনীতিতে ভালো
ভূমিকা রাখত দেশের প্রথম প্রজন্মের আর্থিক প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল ব্যাংক। অথচ
পরবর্তীতে ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের নাজেহাল করে বের করে দেয়া, নামে বেনামে
ঋণ, নানা দুর্নীতি অনিয়মের সংবাদে বারবার শিরোনাম হয় সেই ব্যাংকটি। আর এর
জন্য বরাবরই দায়ী করা হতো শিকদার পরিবারকে। এখন এই শিকদার পরিবারের কেউ নেই
ব্যাংকের নতুন পরিচালনা পর্ষদে। এমনকি ৫ মাস আগে যে পর্ষদে পারভীন হক
শিকদার ছিলেন তাকেও বাদ দেয়া হয়েছে। নতুন পর্ষদের নিয়ন্ত্রণে এখন ন্যাশনাল
ব্যাংক। তবে ১০ সদস্যের পর্ষদে বেশির ভাগ পরিচালকই একটি বড় ব্যবসায়ী
গ্রুপের প্রতিনিধি বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। তাই শিকদার পরিবারের
কর্তৃত্ব থেকে আপাতত রেহাই পেলেও ব্যাংকটির আগামী দিন কিভাবে পরিচালিত হবে,
সুশাসন ফিরবে কি না তা নিয়ে অনেকেই সংশয় প্রকাশ করেছেন। ব্যাংকটির নতুন
চেয়ারম্যান গতকাল সংবাদিকদের কাছে হলফ করে বলেছেন, ন্যাশনাল ব্যাংক দখল
হয়নি। যদিও নবনিযুক্ত পর্ষদের প্রতিনিধি পরিচালকদের তাৎক্ষণিক পরিচয় দিতে
পারেননি তিনি। এমনকি কোন প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি তার সঠিক উত্তর দিতে
পারেননি প্রতিনিধি পরিচালকরাও।
জানা গেছে, দেশের শিল্পায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতো বেসরকারি খাতের
ন্যাশনাল ব্যাংক। দেশের তৈরী পোশাক, টেক্সটাইল খাত, আবাসন খাত, ক্ষুদ্র
ঋণসহ অর্থনীতির সব ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখত ন্যাশনাল ব্যাংক।
কিন্তু গত দেড় দশক ধরে ব্যাংকটি সেই অবদান আর রাখতে পারছে না। আর এজন্য
বারবারই দায়ী করা হতো শিকদার পরিবারের কর্তৃত্ব নিয়ে। নানা অনিয়মে জর্জরিত
ব্যাংকটি দুর্বল ব্যাংকের খাতায় নাম লেখায়। বাধ্য হয়ে ২০২৩ সালের ২১
ডিসেম্বর নিয়ম ও বিধি ভাঙাসহ বিভিন্ন কারণ তুলে ধরে নানা অনিয়মে ধুঁকতে
থাকা বেসরকারি ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেয়ার পাশাপাশি নতুন
পর্ষদ গঠন করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক।
শিকদার পরিবারের কর্তৃত্ব কমানোর জন্য ওই পর্ষদ গঠনের ৫ মাসের মাথায়
কোনো কারণ ছাড়াই তা আবারো ভেঙে দেয়া হয়েছে। আগের পর্ষদ ভেঙে নতুন পর্ষদ গঠন
করে গত ৫ মে সন্ধ্যার পর বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ব্যাংকটির এমডি বরাবর চিঠি
দিয়ে জানিয়ে দেয়া হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের চিঠিতে বলা হয়, ব্যাংক কোম্পানি
আইন, ১৯৯১ (২০২৩ সাল পর্যন্ত সংশোধিত) এর ৪৭ (১) এবং ৪৮ (১) ধারার প্রদত্ত
ক্ষমতাবলে ন্যাশনাল ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদ বিআরপিডির (ব্যাংকিং প্রবিধি ও
নীতি বিভাগ) আদেশের মাধ্যমে অবিলম্বে কার্যকর করে বাতিল করা হয়েছে। চিঠিতে
আরো বলা হয়েছে, আমানতকারী ও ব্যাংকের স্বার্থ রক্ষার্থে এবং ব্যাংকিং
সুশাসন নিশ্চিতকল্পে ও জনস্বার্থে ব্যাংক কোম্পানি আইন ১৯৯১ এর ৪৫ ধারার
ক্ষমতাবলে বাংলাদেশ ব্যাংক ন্যাশনাল ব্যাংকের ১০ সদস্যের পরিচালনা পর্ষদ
নতুনভাবে গঠন করেছে।
যাদের নিয়ে নতুন পর্ষদ গঠন করা হয়েছে : নতুন পর্ষদে চেয়ারম্যান হিসেবে
নিয়োগ পেয়েছেন ন্যাশনাল ব্যাংকের উদ্যোক্তা পরিচালক আলহাজ খলিলুর রহমান। এ
ছাড়া পরিচালক হিসেবে রয়েছেন ব্যাংকটির উদ্যোক্তা শেয়ারহোল্ডার মোয়াজ্জেম
হোসেন, প্রতিনিধি পরিচালক লে. জে. মো: সফিকুর রহমান (অব:), প্রতিনিধি
পরিচালক ও প্রিমিয়ার ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক রিয়াজুল করিম,
ব্যবসায়ী ও প্রতিনিধি পরিচালক এরশাদ মাহমুদ, প্রতিনিধি পরিচালক ও বাংলাদেশ
সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র অ্যাডভোকেট এহসানুল করিম, প্রতিনিধি পরিচালক ও
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর এ কে এম তফাজ্জল হক। এ ছাড়া স্বতন্ত্র
পরিচালক হিসেবে রয়েছেন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর মো: হেলাল
উদ্দীন নিজামী, চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট ড. রতœা দত্ত ও বাংলাদেশ
ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক এ বি এম জহুরুল হুদা।
নতুন পর্ষদের সংবাদ সম্মেলন : গতকাল ন্যাশনাল ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে
নতুন পর্ষদের সদস্যরা সংবাদ সম্মেলন করেন। নতুন পর্ষদের চেয়ারম্যান আলহাজ
খলিলুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, ন্যাশনাল ব্যাংক দখল হয়নি। যদিও নবনিযুক্ত
পর্ষদের প্রতিনিধি পরিচালকদের তাৎক্ষণিক পরিচয় দিতে পারেননি তিনি। এমনকি
কোন প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি তার সঠিক উত্তর দিতে পারেননি প্রতিনিধি
পরিচালকরাও। একপর্যায়ে সংবাদ সম্মেলনস্থল ত্যাগ করেন চেয়ারম্যানসহ
প্রতিনিধিরা। সংবাদ সম্মেলনে চেয়ারম্যান খলিলুর রহমান বলেন, আমরা
ব্যবসায়ীদের প্রয়োজন বুঝি। ফলে ব্যবসায়ীদের জন্য সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নেয়ার
মাধ্যমে ও তাদের পাশে থেকে ন্যাশনাল ব্যাংককে একটি ব্যবসায়ীবান্ধব ব্যাংক
হিসেবে গড়ে তুলতে আমরা বদ্ধপরিকর। এর মাধ্যমে ন্যাশনাল ব্যাংক ঘুরে দাঁড়াবে
ও তার হারানো ঐতিহ্য ফিরে পাবে বলে আমরা দৃঢ়বিশ্বাস করি। ন্যাশনাল
ব্যাংকের এই অগ্রযাত্রায় আমরা সাংবাদিকদের পাশে চাই। ন্যাশনাল ব্যাংক
একীভূত হবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাথে আমাদের
কথা হয়েছে ন্যাশনাল ব্যাংক একীভূত করা হবে না। তারপরই আমরা দায়িত্ব নিয়েছি।
তবে বাংলাদেশ ব্যাংক দ্রুত সময়ের মধ্যে ব্যাংকের আর্থিক উন্নতির শর্ত
দিয়েছে। আমরা আগামী এক বছরের মধ্যে ওই শর্ত পূরণ করার চেষ্টা করবে। আল্লাহ
যদি চায় তাহলে ন্যাশনাল ব্যাংক ঘুরে দাঁড়াবে।
পরে সাংবাদিকরা প্রতিনিধি পরিচালকদের পরিচয় জানতে চাইলে চেয়ারম্যান এর
উত্তর দিতে পারেননি। তিনি বলেন, তারা কোন প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি তা লিখিত
আছে। আমাদের সিএফও পরবর্তীতে আপনাদের জানাবে। কিন্তু উপস্থিত সাংবাদিকরা
প্রতিনিধি পরিচালকদেরই নিজেদের পরিচয় দেয়ার অনুরোধ জানান। এ সময় তারা তাদের
পরিচয় না দিয়ে চেয়ারম্যানসহ স্থান ত্যাগ করেন। একপর্যায়ে সাংবাদিকরা
চেয়ারম্যানের কাছে প্রতিনিধি পরিচালকদের পরিচয় জানতে চান। এ সময় তিনি
প্রতিনিধি পরিচালকরা সরকারের পরিচালক বলে উল্লেখ করেন। এমনকি ব্যাংকটি কোনো
গ্রুপ দখল করেনি বলেও উল্লেখ করেন।
ব্যাংকের জনসংযোগ বিভাগ থেকে নতুন চারজন প্রতিনিধি পরিচালকের পরিচয় দেয়া
হয়। এর মধ্যে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র অ্যাডভোকেট এহসানুল করিম
প্রতিনিধি পরিচালক হয়েছেন সুন্দরবন কনসোর্টিয়াম লিমিটেডের, প্রিমিয়ার
ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক রিয়াজুল করিম প্রতিনিধি হয়েছেন কে ওয়াই
স্টিলের, ব্যবসায়ী এরশাদ মাহমুদ প্রতিনিধি হয়েছেন স্ট্রিস অ্যান্ড ওয়েভস
লিমিটেডের এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর এ কে এম তফাজ্জল হক
প্রতিনিধি হয়েছেন ইস্ট কোস্ট হোল্ডিং লিমিটেডের। আর নতুন করে তিনজন
স্বতন্ত্র পরিচালক করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, যেসব
কোম্পানিগুলোর নাম দেয়া হয়েছে তা একটি বড় ব্যবসায়ী গ্রুপের প্রত্যক্ষ ও
পরোক্ষ মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান বলে ওই সূত্র জানিয়েছে। তাই শিকদার পরিবারের
কর্তৃত্ব থেকে ন্যাশনাল ব্যাংক আপাতত রেহাই পেয়েছে। সামনে ব্যাংকটি কিভাবে
পরিচালিত হবে, ব্যাংকটির হারানো ঐতিহ্য ফিরে পাবে কি না, সুশাসনই বা ফিরে
আসবে কি না এমন হাজারো জিজ্ঞাসা ব্যাংকের সাধারণ বিনিয়োগকারীদের। এসব
প্রশ্নের জবাব পেতে বিনিয়োগকারীদের কিছুদিন অপেক্ষা করতেই হবে।