Hawkerbd.com     SINCE
 
 
 
 
সংকোচনমূলক মুদ্রানীতিতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় [ পাতা ৪ ] 08/05/2024
আলোকপাত
সংকোচনমূলক মুদ্রানীতিতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়
আমাদের দুটো ম্যাক্রো পলিসি রয়েছে মুদ্রানীতি ও রাজস্বনীতি। এ দুই নীতির সমন্বয়সাধন যদি না হয় তাহলে দেশের অর্থনীতির সার্বিক উন্নয়ন কঠিন হয়ে পড়বে। রাজস্বনীতির আওতা অনেক বেশি। রাজস্বের মাধ্যমে সরকারের আয়-ব্যয় ব্যবস্থাপনা হলেও এ নীতি বেসরকারি খাত ও ব্যক্তি খাতসহ সবাইকে সরাসরি প্রভাবিত করে। অন্যদিকে মুদ্রানীতি প্রত্যক্ষভাবে না হলেও পরোক্ষভাবে প্রভাব বিস্তার করে। তাৎক্ষণিকভাবে এটির ফলাফল আমরা প্রত্যক্ষ করি না। যেহেতু মুদ্রানীতির সঞ্চালন প্রক্রিয়া কিছুটা ধীরগতিসম্পন্ন। ব্যাংক বা বাজারের মাধ্যমে এটি সঞ্চারিত হয়ে থাকে। তবে এর আওতাও অনেক বেশি। আমাদের পরবর্তী বাজেটের সময় সমাগত। বাজেট প্রেক্ষাপট বিবেচনায়ও বাজেটের সঙ্গে মুদ্রানীতি ও রাজস্বনীতির যোগসাজশ মনে রাখতে হবে।

মুদ্রানীতি নিয়ে আমার কিছু কিছু ক্ষেত্রে আপত্তি আছে। বাংলাদেশে যে মুদ্রানীতি হচ্ছে, এতে পলিসিগত কিছু সমস্যা রয়েছে বলে আমি মনে করি। এখন আমাদের সমস্যাগুলো হচ্ছে মূল্যস্ফীতি, কর্মসংস্থানের স্থবিরতা এবং প্রবৃদ্ধির স্থবিরতা। আমি মনে করি, এর পেছনে কিছু পলিসিগত সমস্যা রয়েছে। অবশ্যই দুর্নীতি ও প্রাতিষ্ঠানিক সমস্যারও ভূমিকা রয়েছে এতে।

বর্তমানের সমস্যা ব্যাখ্যা করতে গেলে আমাদের তার কারণ অনুসন্ধান করতে হবে। আমরা অনেক সময় গৎবাঁধা কিছু পলিসি অনুসরণ করে থাকি। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সেটা বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) প্রেসক্রিপশনে। যেমন সম্প্রতি আইএমএফ আমাদের কিছু নিয়ম বেঁধে দিয়েছে। আইএমএফের কিন্তু চিরাচরিত তিনটা নীতি আছে—প্রথমত নমনীয় বিনিময় হার, দ্বিতীয়ত নমনীয় ও উচ্চ সুদহার (দেয়ার ইজ নাথিং কলড চিপ মানি) এবং তৃতীয়ত হলো কঠোর মুদ্রানীতি। এরা আপ্তবাক্যের মতো তিনটি নীতি অনুসরণ করতে বলে। এই তিনটিই অ্যাডাম স্মিথ বর্ণিত অদৃশ্য হাত (ইনভিজিবল হ্যান্ড) যেন সব কাজ করে ফেলবে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এর বাইরে অনেক বিষয় আছে, যেখানে আমাদের গৎবাঁধা পলিসির বাইরে যেতে হবে।

নমনীয় বিনিময় হারের দরকার আছে। তবে একেবারে নমনীয় বিনিময় হার করলে বিপদও আছে। সম্প্রতি যেমন বাংলাদেশ ব্যাংক ‘‌ক্রলিং পেগ’ নীতির কথা বলছে। কিন্তু একেবারে কঠোর মুদ্রানীতিও কিন্তু অর্থনীতির জন্য ভালো নয়। আমরা অনেকদিন নয়-ছয়ের ফাঁদে ছিলাম। আবার এখন সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি গ্রহণ করা হচ্ছে। কিন্তু আমরা এসবের বাইরে যদি না যাই তাহলে হবে না। একটা উদাহরণ দিই। আর্জেন্টিনা প্রায় ৪০-৫০ বছর ধরে আইএমএফের প্যাকেজ গ্রহণ করছে। কিন্তু তারা এখনো বের হতে পারেনি। পাকিস্তান তো আরেকটি উদাহরণ এক্ষেত্রে। সম্প্রতি দেখলাম কয়েকটি দেশ ঋণে ভারাক্রান্ত দরিদ্র দেশে (এইচআইপিসি) পরিণত হয়েছে। ভাগ্যক্রমে সেসব দেশের মধ্যে বাংলাদেশের নাম নেই। আশা করি বাংলাদেশ এ রকম দেশ হবেও না। কেননা এ দেশের অবস্থা এতটা শোচনীয় নয়। কিন্তু আমাদের এ বৈদেশিক ঋণসহায়তা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।

প্রথমত আমাদের সম্প্রসারণমূলক মুদ্রানীতি দরকার। সরকারি আয়-ব্যয় রাজস্ব দ্বারা পরিচালিত হলেও এর অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। প্রথমেই যে বিষয়টি আসে তা হলো রাজস্ব আহরণের ক্ষেত্র হবে কোনটা। প্রত্যক্ষ করের মাধ্যমে নাকি পরোক্ষ করের মাধ্যমে রাজস্ব আহরণ করা হবে? এ ব্যাপারে অনেক আলোচনা আছে।

আমাদের কর সক্ষমতা কম। পরোক্ষ কর আহরণে আমাদের ঝোঁক বেশি। প্রত্যক্ষ কর আদায় অনেক কঠিন। পরোক্ষ কর আদায় করা সহজ, খুব সহজে এটি চাপিয়ে দেয়া যায়। যেমন ভ্যাট আরোপ। রুটির ওপর কোনো দরিদ্র ব্যক্তি যদি ৫ টাকা কর দেয়, হাজার কোটি টাকার মালিক কোনো ধনী ব্যক্তিও একই কর দেয়। সব শ্রেণীর মানুষের জন্য সমান এ পরোক্ষ করে কিন্তু ইকুইটির (সমতা) প্রশ্ন আসে। এদিকে আমরা কিন্তু প্রত্যক্ষ কর আহরণে তেমন সাফল্য দেখাতে পারছি না। আমাদের রিসোর্স মোবিলাইজেশনে (সম্পদ ব্যবস্থাপনা) সমস্যা আছে। মুদ্রানীতি যদি রিসোর্স মোবিলাইজেশনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ না হয় তাহলে চলবে না। এখন যদি আমদানি নিয়ন্ত্রণ করা হয় তখন কিন্তু আমদানি শুল্কও কমবে। এতে আমাদের আমদানি রাজস্বও কমবে। এর প্রভাব পড়বে গিয়ে শিল্পোৎপাদনেও। অর্থাৎ হঠাৎ করে মুদ্রানীতির মাধ্যমে আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলে তো চলবে না। স্নো-পাউডার, পাউরুটি ও চানাচুর আমদানি নিষেধাজ্ঞা দিয়ে তো আপনি ব্যালান্স অব পেমেন্ট (বিওপি) বা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়াতে পারবেন না।

আমি মনে করি সংকোচনমূলক মুদ্রানীতিতে সবসময় ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন। এমনিতেই ব্যাংকাররা তাদের ঋণ দিতে চান না, ঋণ না দেয়ার জন্য নানা বাহানা তৈরি করেন। তার ওপর সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি থাকলে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের একদমই ঋণ দেবেন না। মি. রয় চৌধুরী নামে এক ভদ্রলোক ৪০টির মতো দেশের ওপর গবেষণা করে দেখিয়েছেন, সংকোচনমূলক মুদ্রানীতিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা। বড় ব্যবসায়ীদের ওপর অবশ্য এর প্রভাব খুব একটা পড়ে না। বড় ব্যবসায়ীরা ঋণ পান কারণ তারা হয়তো তথাকথিত জামানত দিতে পারেন। কিন্তু বর্তমান বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট মাথায় রেখে আমাদের ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের ওপর মনোনিবেশ করার প্রয়োজনীয়তা আছে। বাংলাদেশ ব্যাংকেরও অবশ্য একটা দায়িত্ব আছে—বাজারে চাহিদা বেড়ে গেলে মুদ্রা সরবরাহ কমাতে হবে। সেজন্য হয়তো মাঝে মাঝে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি নেয়া হয়। তবে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের হাতে যেন ঋণ পৌঁছায় সেজন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে নির্দেশনা দিতে হবে। আমি শুনেছি বাংলাদেশ ব্যাংক সেটা করছে।

বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের কথা যদি বলি, আর্থিক হিসাব নেতিবাচক তবে চলতি হিসাব ইতিবাচক। আর্থিক হিসাব নেতিবাচক মানে অধিক হারে বৈদেশিক মুদ্রা দেশে আসছে না। বিনিয়োগ খাত যদি আকর্ষণীয় না করি তাহলে কেন বৈদেশিক মুদ্রা আসবে? মুখে বললে হবে না যে দেশে আসো, বাণিজ্য করো। বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে হবে। বিনিয়োগ আকর্ষণে আমাদের অনেক জটিলতা রয়েছে। জমি রেজিস্ট্রেশনে জটিলতা আছে। এসব জটিলতা থাকলে বাইরের লোকজন কীভাবে আসবে? দেশের লোকেরা দেশের অভ্যন্তরে বিনিয়োগ করে না। তারা দেশের টাকা বাইরে পাঠানোর জন্য অস্থির হয়ে আছে।

আমাদের প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগ (এফডিআই) আসছে না। ফরেন পোর্টফোলিও ইনভেস্টমেন্ট (এফপিআই) আরো কম। আমাদের স্টক মার্কেটের যে করুণ অবস্থা এফপিআই আসবে কী করে! এদিকে আমাদের রেমিট্যান্সও কম এবং তা বাড়ানোর জন্য যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। রেমিট্যান্স আকর্ষণে ও হুন্ডি কমাতে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। হুন্ডি কমানোর জন্য কিন্তু অনেক আইনকানুন আছে। হাওয়ালা বা হুন্ডি একেবারে নির্মূল করা কঠিন হলেও এটি কমানো সম্ভব। আমাদের পলিসিতে যদি এসব বিষয় লক্ষ না করি তাহলে অবস্থা খারাপের দিকে এগোবে।

মুদ্রানীতির একটা দিক হলো ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসার করা, কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা। সেটা যদি আমরা না করি, একদিকে রাজস্ব বাজেটে আয়কর, ভ্যাট ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত করা হবে কিন্তু রাজস্ব আহরণ সম্ভব হবে না। সেটা কিন্তু আমরা বারবার দেখতে পাচ্ছি। বাজেটটা সাধারণত সম্প্রসারণশীল হয়। এতে আমাদের কিছু কাজ হলেও আমাদের চাহিদা অনেক। যে কারণে সম্পদ অনেক বেশি লাগে। মুদ্রানীতি যদি আমরা সংকোচনশীল করি, যেটা এবার করেছে, তাতে মানি সাপ্লাই কমাবে। মানি সাপ্লাই কমানোর মূল উদ্দেশ্য হলো মূল্যস্ফীতিটা কমানো। মূল্যস্ফীতি কিন্তু কমানো যাচ্ছে না। আমরা সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি করে ফেলছি, কিন্তু সমস্যা হচ্ছে আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটছে না।

আমাদের রাজস্বনীতি নিয়ে কথা হলো, আমাদের কর-ডিজিপি হার বাড়াতে হবে। কর ফাঁকি দেয়া ঠেকাতে হবে। আবার আইএমএফের কথামতো সেচের পানি, ডিজেল ইত্যাদির ওপর হরেদরে কর বাড়ানো যাবে না। কর রেয়াত বাতিল করো, প্রণোদনা কমিয়ে দাও—আইএমএফের এ ধরনের পরামর্শ চোখ বুঝে অনুসরণ করা যাবে না। আইএমএফের বেশির ভাগ নীতি কিন্তু অনেকটা এক জুতা সবার পায়ে পরিয়ে দেয়ার মতো ব্যাপার। আইএমএফ অনেক কথা বলে, সব কথা শোনা যাবে না। আমি যখন গভর্নর ছিলাম তখন বৈদেশিক মুদ্রার রেগুলেশন একটু কঠিন ছিল। একবার আইএমএফের প্রতিনিধি বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারে হস্তক্ষেপ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। আমরা কিন্তু সুকৌশলে তাদের অনেক পরামর্শ এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেছি। ব্যাংক খাতে দুষ্টের দমন শিষ্টের লালনও কিন্তু করতে হবে।

সবশেষে বলব, মুদ্রানীতি কিন্তু সরল কোনো বিষয় নয়, এটা বেশ জটিল। ফ্রেডরিক মিশকিন নামে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভের বোর্ড অব গভর্নর্সের (২০০৬-২০০৮) এক সদস্য ছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক এ গভর্নর বলতেন, মুদ্রানীতি কোনো ডেন্টিস্টের কাজ নয়। আপনি যদি কোনো ডেন্টিস্টের কাছে যান এবং বলেন আপনার কোন দাঁতে ব্যথা তাহলে সে চট করে ওই দাঁত তুলে ফেলবে। অন্য কোনো দাঁতে সমস্যা আছে কিনা, শরীরের অন্য কোথাও সমস্যা আছে কিনা তা দেখবে না। কিন্তু মুদ্রানীতি ব্যবস্থাপনার কাজটি সে রকম নয়। মুদ্রা সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করেন, বিনিময় হার নিয়ন্ত্রণ করেন কিন্তু আপনাকে কোনো সমস্যার গভীরে গিয়ে দেখতে হবে। বাংলাদেশে কেন বিনিময় হারে জটিলতা চলছে, আর্থিক হিসাব কমছে, কেন বৈধ চ্যানেলে টাকা আসছে না—হুন্ডিতে আসছে। এ ধরনের নানা সংকটের বিষয়গুলো কারো অজানা নয়। এখন কথা হলো সঠিক পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে কিনা। সব দেশের অর্থনীতিতেই ঝুঁকি থাকে। কিন্তু যদি অনিশ্চয়তা থাকে তাহলে তো হবে না। আমাদের ব্যাংক খাতে অনিশ্চয়তা রয়েছে, সার্বিক অর্থনীতিতে অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে।

একটি গল্প দিয়ে শেষ করি, একবার এক বন্ধুর সঙ্গে ভিয়েতনামে গিয়েছিলাম। আমরা যে হোটেলে ছিলাম, সেখানে একজন দক্ষিণ কোরিয়া থেকে আসা এক ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা হলো। তাকে আমার বন্ধু জিজ্ঞেস করেছিল—আপনি কি কখনো বাংলাদেশে গিয়েছিলেন? বাংলাদেশ কিন্তু বিনিয়োগের জন্য ভালো একটি দেশ, এখানে অনেক সুযোগ ও সম্ভাবনা রয়েছে। তখন ওই ভদ্রলোক বলেছিলেন, বাংলাদেশ যে অনেক সম্ভাবনার এবং সেখানে অনেক সুযোগ রয়েছে তা আমি জানি। কারণ আমি প্রায় এক বছর সেখানে ছিলাম। কিন্তু আমি কোনো বিনিয়োগ করতে পারিনি। কারণ প্রত্যেক চেয়ার, প্রত্যেক টেবিল, প্রত্যেক দরজা টাকা চায়। আর আমি ভিয়েতনামে মাত্র দুই মাসের মধ্যে আমার বিনিয়োগ করতে পেরেছি।

স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাবে এবং জন-আকাঙ্ক্ষাকে আমলে না নেয়ার অভাবেই কিন্তু আমরা রাজনীতি ও অর্থনীতিতে একটু হতাশায় ভুগছি।
News Source
 
 
 
 
Today's Other News
More
Related Stories
 
Forward to Friend Print Close Add to Archive Personal Archive  
Forward to Friend Print Close Add to Archive Personal Archive  
 
 
Home / About Us / Benifits / Invite a Friend / Policy
Copyright © Hawker 2013-2012, Allright Reserved