রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (রুয়েট) প্রভাব খাটিয়ে
চাকরি নেন মুফতি মাহমুদ রনি। এর পর তিনি প্রশাসনকে হাত করে একের পর এক
অনিয়ম-দুর্নীতি করছেন। সহকারী রেজিস্ট্রার (সহকারী পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক) থেকে
জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে ১৩ বছরে হয়েছেন গবেষণা ও সম্প্রসারণ বিভাগের
অতিরিক্ত পরিচালক। অভিযোগ রয়েছে, কাল্পনিক পদটিও প্রভাবশালী কর্মকর্তা রনির
জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে। অন্যের থিসিস নিজের নামে চালিয়েছেন; জালিয়াতির
মাধ্যমে একাডেমিক বিভিন্ন সনদও নিয়েছেন তিনি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১০ সালের ৫ অক্টোবর প্রকাশিত নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির
আলোকে সহকারী রেজিস্ট্রার (সপ্তম গ্রেড) পদে আবেদন করেন রনি। বিজ্ঞপ্তিতে
পদটির জন্য ন্যূনতম যোগ্যতা সরকারি/আধা-সরকারি কিংবা স্বায়ত্তশাসিত
প্রতিষ্ঠানে প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা হিসেবে
প্রশাসনিক/একাডেমিক/পরীক্ষা-সংক্রান্ত কাজে পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতা চাওয়া হয়।
কিন্তু প্রভাব খাটিয়ে রনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির শর্ত
শিথিলে বাধ্য করেন। এর পর যে কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে প্রশাসনিক কাজের ৫ বছরের
অভিজ্ঞতার শর্ত হিসেবে তিনি ঢাকার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ‘এস এম
এন্টারপ্রাইজ লিমিটেড’-এর লিয়াজোঁ অফিসার হিসেবে ৬ বছর ৫ মাস ১১ দিনের
(২০০৩ সালের ২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত) অভিজ্ঞতা উল্লেখ করেন। সপ্তম গ্রেডের
পদটিতে রনির আবেদনের যোগ্যতা না থাকলেও তৎকালীন প্রশাসনকে ‘ম্যানেজ’ করে
চাকরি বাগিয়ে নেন।
সূত্রের দাবি, ৬ বছর ৫ মাস ১১ দিনের ‘লিয়াজোঁ অফিসার’ পদে যে সনদ দেখিয়ে
রনি সহকারী রেজিস্ট্রার পদে চাকরিতে ঢুকেছেন, ওই সময়ে আরএম সলিউশন, আব্দুর
রহিম অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস এবং রেডিয়েন্ট পাওয়ার ইঞ্জিনিয়ারিংয়েও কাজ করার
তথ্য পাওয়া গেছে। এ বিষয়ে মাহমুদ রনি সমকালকে বলেন, সহকারী রেজিস্ট্রার
পদে নিয়োগের সব শর্ত পূরণ করার পরই প্রশাসন আমাকে চাকরি দেয়। পরে নিয়োগ
(উপপরিচালক) ও পদোন্নতির (অতিরিক্ত পরিচালক) ক্ষেত্রে নিয়মের কোনো ব্যত্যয়
হয়নি। যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা না থাকলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আমাকে কেন নিয়োগ
দিল? পরে পদোন্নতিও দিয়েছে।
রুয়েটের এ কর্মকর্তা ২০১৬ সালেও উপপরিচালক (গবেষণা ও সম্প্রসারণ) পদে
নিয়োগ পেতে জালিয়াতির আশ্রয় নেন। আগের সেই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের ভুয়া
সনদের সঙ্গে বর্তমান চাকরির ৫ বছর মিলিয়ে ১০ বছর অভিজ্ঞতা দেখিয়ে শর্ত পূরণ
করে পুলিশ ভেরিফিকেশন ছাড়াই ৮০তম সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ২০১৭ সালের ২৯
এপ্রিল উপপরিচালক (গবেষণা ও সম্প্রসারণ) পদে নিয়োগ পান।
এখানেই থেমে থাকেননি রনি। ২০২১ সালের ৩১ অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি
কমিশনের (ইউজিসি) পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ম্যানেজমেন্ট বিভাগের পরিচালক
(অতিরিক্ত দায়িত্ব) মোহাম্মদ জামিনুর রহমান স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে পাবলিক
বিশ্ববিদ্যালয়ে চতুর্থ গ্রেডভুক্ত পদ হিসেবে অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার/সমমানের
পদ সৃষ্টি প্রসঙ্গে একটি চিঠি ইস্যু হয়। চিঠিতে বলা হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের
শুধু রেজিস্ট্রার, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, অর্থ
ও হিসাব এবং লাইব্রেরি– এই চার দপ্তরে চতুর্থ গ্রেডভুক্ত পদ থাকবে।
চিঠিতে আরও বলা হয়, চাকরির ন্যূনতম যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা শিথিলযোগ্য নয়।
উন্মুক্ত বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে সরাসরি নিয়োগ দিতে হবে; পদোন্নতি/আপগ্রেডেশন
দেওয়া যাবে না। অভিযোগ রয়েছে, প্রশাসনকে জিম্মি করে রনি গবেষণা ও
সম্প্রসারণ দপ্তরে উন্মুক্ত নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই ২০২১ সালের ৩০ নভেম্বর
চতুর্থ গ্রেডভুক্ত অতিরিক্ত পরিচালক পদে আপগ্রেডেশন/পর্যায়োন্নয়ন নেন।
সরকারি/আধা-সরকারি কিংবা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে প্রথম শ্রেণির
কর্মকর্তা হিসেবে কমপক্ষে ১৩ বছরের অভিজ্ঞতার শর্ত পূরণ করেননি। রুয়েটের
অর্গানোগ্রামে গবেষণা ও সম্প্রসারণ দপ্তরে অতিরিক্ত পরিচালক নামে কোনো পদের
অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি।
২০১১ সালে রনি চাকরির আবেদনে একই সঙ্গে রুয়েটে এমএসসি এবং রাজশাহী
বিশ্ববিদ্যালয়ে এমবিএ প্রোগ্রামে অধ্যয়নরত থাকার তথ্য উল্লেখ করেননি। অথচ
চাকরি পাওয়ার পর ২০১১ সালের ১২ জুলাই এমএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্স সম্পন্ন
করতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বরাবর আবেদন করেন তিনি। রুয়েটে চাকরিরত অবস্থায়
এমএসসি কোর্স সম্পন্নের জন্য আবেদন করলেও একই সময়ে দুটি প্রতিষ্ঠানে
(রুয়েটে এমএসসি ও রাবিতে এমবিএ) অধ্যয়নরত থাকার বিষয় গোপন করেন রনি।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে না জানিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ সনদ
পেয়ে যান তিনি। পরে আবার এ সনদ চাকরির ব্যক্তিগত নথিতে অন্তর্ভুক্ত করতে
২০১৩ সালে তৎকালীন উপাচার্য বরাবর আবেদন করেন রনি।
ছাড়া প্রভাবশালী এ কর্মকর্তা এমএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রির (রোল:
০৮০৪২০২০০১) অংশ হিসেবে যে থিসিস করেছেন, তা অন্যের অভিযোগ উঠেছে। রনি
০৭২০৯৯ রোল নম্বরধারী মো. মোস্তাফিজুর রহমান ও ০৭২০৬২ রোল নম্বরধারী কামরুন
নাহার নামের বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্সের দুই শিক্ষার্থীর যৌথ থিসিস পেপার
নকল করে নিজের নামে জমা দেন।
এ বিষয়ে মাহমুদ রনি বলেন, ‘রুয়েটে এমএসসি করার জন্য অনুমতি নিলেও রাবিতে
এমবিএ সান্ধ্য কোর্স করতে অনুমতি নেইনি। দুই শিক্ষার্থী বিএসসির থিসিস
করেছে; আমি এমএসসির। তবে একই শিক্ষক তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন আমাদের। থিসিস করার
সময় শিক্ষক তাদের আমার সঙ্গে কাজ করতে বলেন। এ কারণে থিসিসের কিছু বিষয়
মিলে গেছে। একে নকল কিংবা জালিয়াতি বলা ঠিক হবে না।’
জানতে চাইলে রুয়েটের তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক সিরাজুল করিম চৌধুরী
বলেন, ‘১৩ বছর আগের কথা তেমন মনে নেই। আমি ছাড়াও নিয়োগ বোর্ডে ৬-৮ সদস্য
ছিলেন। পরীক্ষা-ভাইভার পরই চাকরিপ্রার্থীকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। মাহমুদ রনির
বিষয়ে নোট অব ডিসেন্ট ছিল কিনা, মনে নেই।’
রুয়েটের বর্তমান রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) আরিফ হোসেন চৌধুরী বলেন,
‘তৎকালীন প্রশাসন রনিকে কীসের ভিত্তিতে নিয়োগ দিয়েছে, তা জানি না। নিয়োগ
কিংবা পদোন্নতির ক্ষেত্রে রনি জালিয়াতি করে থাকলে তা সিন্ডিকেট কিংবা ফাইলে
নোট দিতে হবে। চাকরিরত অবস্থায় অনুমতি ছাড়া কোথাও অধ্যয়নের সুযোগ নেই। আর
থিসিস জালিয়াতি ফৌজদারি অপরাধ। কারও থিসিসের সঙ্গে ৩০ শতাংশ মিলে গেলেই,
সেটি অপরাধ এবং বাতিলযোগ্য।’