ইউরোপের বিভিন্ন দেশে লোক পাঠোনোর নামে প্রতারণা, পুলিশ ক্লিয়ারেন্স জালিয়াতি, ইতালির অফার লেটার (নলস্তা) টেম্পারিং, রিক্রুটিং লাইসেন্সের ভুয়া নাম্বার ব্যবহারসহ নানা অপরাধে জড়িত মাহিয়া ট্রাভেলস্ এ- ট্যুরসের মালিক ইউসুফ আলী। তিনি চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌর এলাকার ধাপাপাড়ার বাসিন্দা। প্রতারণার টাকায় তিনি এখন কোটিপতি। বহু বছর ধরেই প্রতারণায় মোড়ানো তার জীবন। গত ৪ঠা মে মানবজমিনে ‘বিদেশের স্বপ্ন দেখিয়ে কোটি টাকা লোপট’ শিরোনামে তাকে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। এরপর চাঁপাইনবাবগঞ্জজুড়ে তাকে নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। প্রতিবেদন প্রকাশের পরদিন মাহিয়া ট্রাভেলস্ এ-ট্যুরসের সাইনবোর্ড খুলে ফেলা হয়েছে। গত ৬ই মে প্রকাশিত সংবাদের প্রতিবাদও জানিয়েছেন ইউসুফ আলী। প্রতিবাদ লিপিতে তিনি নিজেকে রিক্রুটিং লাইসেন্স নং-২৭২২ এর অথরাইজ এজেন্ট দাবি করেন। তবে রিক্রটিং লাইসেন্স নং-২৭২২ এর প্রতিষ্ঠানটির নাম এসএসবি গ্লোবাল ওভারসিজ লিমিটেড।
ওই প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থপনা পরিচালক বলেছেন, রিক্রুটিং লাইসেন্স অথরাইজ দেয়ার সুযোগ নেই। চাঁপাইনবাবগঞ্জের ইউসুফ আলী নামের কোন ব্যক্তি আমাদের প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কোন লোক পাঠাননি। প্রতিষ্ঠানটির সুনাম ক্ষুণ্ন করতে তিনি প্রতিবাদে আরএল নং-২৭২২ ব্যবহার করেছেন। অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রতারণা করেই কামিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। প্রতারণার টাকায় আতপ ধান গুদামজাত ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে এফডিআর করেছেন।
কয়েক বছর আগে ভিসা জালিয়াতির কারণে ঢাকায় সিআইডির হাতে আটক হন। সেখান থেকে দেনদরবার করে ছাড়া পান। সাইপ্রাসের ভিসা জালিয়াতির অভিযোগে র্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হন এই ইউসুফ। পুলিশ ক্লিয়ারেন্স জালিয়াতির বিষয়টিও ওপেন সিক্রেট। প্রতারণার টাকায় মসজিদে দান আর এতিমখানায় আর্থিক সহায়তা করে সমাজের সহানূভূতি নেয়ার চেষ্টা করেন। স্থানীয় জনপ্রতিনধি ও নেতাদের সঙ্গে সখ্যতার কারণে প্রশাসন তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেইনি। রয়েছে নিজস্ব মাস্তান বাহিনীও।
একসময় তার সঙ্গে কাজ করতেন এমন কয়েকজন এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা বলেন, এই ইউসুফ সাইপ্রাসে ছিলেন। সাইপ্রাসে থাকা অবস্থায় তিনি মানবপাচারকারী চক্রের সন্ধান পান। তিনি দেশে ফিরেন এক দশক আগে। দেশে এসেই তিনি জড়িয়ে পড়েন একটি মানবপাচারকারী চক্রের সঙ্গে। চক্রের দালাল হিসেবে বিভিন্ন এজেন্সির মাধ্যমে বিদেশে লোক পাঠানো শুরু করেন তিনি। মাহিয়া ট্রাভেলস এন্ড ট্যুরস নামে একটি ট্রাভেল এজেন্সি অফিস করেন শহরের শান্তিমোড়ে। জানা গেছে, চাঁপাইনবাবগঞ্জের প্রতিটি গ্রামে প্রবাসীদের ছড়াছড়ি। তাদের ওপর ভর করে বদলে গেছে অধিকাংশের পারিবারিক অবস্থা। ইতালিপ্রবাসী ও তাদের পরিবারের এই ভাগ্যবদল দেশটিতে যেতে আগ্রহী করেছে চাঁপাইনবাবগঞ্জের যুবকসহ বিভিন্ন বয়সীদের। এই স্বপ্নকেই পুঁজি করে গড়ে উঠেছে ইউসুফের মতো ভয়ংকর মানবপাচারকারী চক্র।
ঝুঁকিপূর্ণ অবৈধ পথে যাচ্ছে ইতালি । এদের ফাঁদে পা দিয়ে সর্বস্ব হারাচ্ছেন অনেকেই। ভুক্তভোগীদের অনেকেই পুলিশ সুপার কার্যালয় ও থানায় অভিযোগ করেও তাদের টাকা ফেরত পাচ্ছেনা। অভিযোগের বিষয়ে তদন্তকারী কর্মকর্তা জেলা গোয়েন্দা পুলিশের এসআই আসগর আলী জানান, এ বিষয়ে একটি অভিযোগ তার কাছে আছে। বাদীরা সমাধানের মাধ্যমে টাকা ফেরত চান। তিনি চেষ্টা করছেন কিন্তু সমাধান হয়নি। তাদের আদালতে মামলার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। এসএসবি গ্লোবাল ওভারসিজ লিমিটেড মো. শামীম হোসেন জানান, রিক্রুটিং লাইসেন্স অথরাইজ দেয়ার সুযোগ নেই। তবে মাঠপর্যায়ের ভিসা প্রসেসিংয়ে আগ্রহী কর্মীদের আমরা একটা চুক্তি করে থাকি। সেখানেও উল্লেখ করা থাকে তারা আর্থিক লেনদেন করতে পারবে না।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের ইউসুফ নামের কোন ব্যক্তি আমাদের প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কোন লোক পাঠাননি। ওই প্রতিবাদে ইউসুফ দাবি করেছেন তিনি ইতালিতে লোক পাঠান। আমাদের এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ইতালিতে লোক পাঠানোর কোন সুযোগ নেই। এ বিষয়ে ইউসুফ আলী জানান, ইতালি সরকারও কোরিয়ার মতো সার্কুলার দিয়ে লোক নেই। ইতালিতে লোক পাঠানো সরকার অনুমোদিত। ইতালিতে আমার বন্ধু থাকে তার মাধ্যমে বাংলাদেশের লোক পাঠায়। অনেকেই বৈধ উপায়ে ইতালিতে লোক পাঠাচ্ছে। রিক্রুটিং লাইসেন্স অথরাইজ নেয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাকে অথরাইজ দিয়েছে। আপনার (প্রতিবেদক) সন্দেহ থাকলে ঢাকায় আসেন অফিসে (এসএসবি গ্লোবাল ওভারসিজ লিমিটেড) গিয়ে প্রমাণ করবো। পুলিশ ক্লিয়ারেন্স, জাল ভিসা দেয়া ও ইতালির অফার লেটার টেম্পারিংয়ের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তবে তিনি স্বীকার করেছেন, কিছু লোকের টাকা নিয়েও তাদের ভিসা দিতে পারেননি। তাদের টাকা তিনি ফেরত দিয়ে দিবেন।