মূল্যস্ফীতি
নিয়ন্ত্রণ ও অর্থনৈতিক সংকট নিরসনে ৬ ও ৯ সুদহার নীতি ভেঙে স্মার্ট সুদহার
নীতি ঘোষণায় আরো বেশি বিপাকে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা। একই সঙ্গে মূল্যস্ফীতির
চাপও ঊর্ধ্বমুখীই রয়েছে। নতুন এ স্মার্ট নীতির কারণে প্রতি মাসে বাড়ছে
ব্যাংক ঋণের সুদহার।
অথচ সে হারে বাড়ছে না ব্যবসায়ীদের আয় ও আনুষঙ্গিক সুযোগসুবিধা। এতে
শিল্পোৎপাদনের খরচ বাড়ছে প্রতিনিয়ত; যা ব্যবসাবাণিজ্য বিপর্যস্ত করে ফেলছে।
এর ফলে নতুন কোনো বিনিয়োগে আগ্রহী হচ্ছেন না শিল্পোদ্যোক্তারা। এমনকি
শিল্পায়ন তো হচ্ছেই না বরং উল্টো চলমান শিল্প ইউনিটগুলো টিকিয়ে রাখাও কঠিন
হয়ে পড়েছে। বাধাগ্রস্ত হচ্ছে কর্মসংস্থান; যা দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি আরো
গভীর সংকটের দিকে ঠেলে দিচ্ছে বলে মনে করেন ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদরা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি এপ্রিলে ব্যাংকিং খাতে ঋণের হার ১৩
দশমিক ৫৫ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। মার্চে এটি ছিল ১৩ দশমিক ১১, ফেব্রুয়ারিতে ১২
দশমিক ৪৩, জানুয়ারিতে ১১ দশমিক ৮৯ এবং গত বছরের ডিসেম্বরে ১১ দশমিক ৪৭ ও
নভেম্বরে ১০ দশমিক ৯৩ শতাংশ।
নতুন এ নীতির ফলেই সুদের হার ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে বলে মনে করেন ব্যবসায়ী ও
সংশ্লিষ্টরা। জানা গেছে, বৈশ্বিক সংকট নিরসনের জন্য সুদহার নির্ধারণে
বর্তমানে একটি নতুন পদ্ধতি অনুসরণ করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর নাম ‘সিক্স
মান্থস মুভিং অ্যাভারেজ রেট অব ট্রেজারি বিল’ বা স্মার্ট পদ্ধতি; যা গত
বছরের অক্টোবরে চালু করা হয়েছে। এ পদ্ধতি চালুর চার মাসেই ব্যবসাবাণিজ্যের
ব্যয় আগের চার মাসের তুলনায় অনেক বেড়ে গেছে। এতে ব্যবসাবাণিজ্য খাতে তৈরি
হয়েছে নতুন অনিশ্চয়তা।
ব্যবসায়ীদের মতে, ক্রমাগত ঋণের সুদহার বৃদ্ধির ফলে বিরাজমান কঠিন অর্থনৈতিক
অবস্থার সঙ্গে ব্যবসায় যোগ হয়েছে আরো দুর্দশা; যা চলমান সংকট আরো ঘনীভূত
করছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে ব্যবসাবাণিজ্যে স্থায়ী মন্দা পরিস্থিতি সৃষ্টির
আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীরা।
একই সঙ্গে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, শুধু সুদহার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ
করা যাবে না। এটা তো পশ্চিমা দেশগুলোর মতো নয় যে পরিবারের সবাই কাজ করেন।
এখানে পাঁচজনের একটা পরিবারে কাজ করেন একজন বা দুজন। ফলে আয় কম কিন্তু ব্যয়
বেশি। এজন্য বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। শিল্পায়নের জন্য
সহায়ক সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
গৃহীত নতুন এ স্মার্ট নীতির ফলে এর মধ্যে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের দ্বিতীয়
ত্রৈমাসিকে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ৩ দশমিক ৭৮ শতাংশে নেমে
এসেছে, যা এ অর্থবছরের প্রথম ত্রৈমাসিকে ছিল ৬ দশমিক ০১ শতাংশ।
আবার
মূল্যস্ফীতির চাপও এখনো ২ অঙ্কের ঘরের কাছাকাছিই রয়েছে।
জানা গেছে, মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ব্যাংক সুদের হার বাড়ানোর ফর্মুলা বেছে
নিয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ, যা তাদের জন্য ভালো ফলও এনে দিয়েছে। এরই
ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ ব্যাংকও গত বছরের জুলাইয়ে একটি মুদ্রানীতির মাধ্যমে
নতুন এ সুদহার বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেয়, যা ওই বছরের অক্টোবরে কার্যকর
হয়। নতুন এ নীতি বাস্তবায়নের ফলে সমস্যা সমাধান হওয়া দূরের কথা, সংকট আরো
বেড়েছে। অনেক ব্যবসায়ীই নতুন এ সুদহারকে ব্যবসাবাণিজ্যের জন্য অতিরিক্ত চাপ
বলে মনে করছেন।
জানা গেছে, বর্তমানে আমানতের হার ৬ থেকে ৭ এবং ঋণের সুদহার ১২ থেকে ১৩
শতাংশ পর্যন্ত।
এখানে পার্থক্য দাঁড়াচ্ছে ৬ শতাংশ; যা দেশের ব্যাংকিং খাতে
এক অসমতার সৃষ্টি করছে। এদিকে মূল্যস্ফীতির কারণে ইতোমধ্যে কাঁচামালের দাম
বেড়েছে। ব্যবসার খরচ এবং শ্রমিক ব্যয়ও লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। এ পরিস্থিতিতে
ব্যাংক ঋণের ক্রমবর্ধমান সুদহার ব্যবসা ঝুঁঁকির মধ্যে ফেলছে। ব্যবসায়ীদের
অনেকেই বলছেন, আমরা যারা ব্যবসা শুরু করার সময় ঋণ নিয়েছিলাম ৮ থেকে ৯ শতাংশ
সুদে, এখন সেই ঋণের সুদ দিতে হচ্ছে ১৪ থেকে ১৫ শতাংশ হারে। কোথা থেকে আসবে
এ বাড়তি টাকা?’ এটাকে একটা ভ্রান্ত নীতি হিসেবেই আখ্যা দিয়েছেন অনেক
ব্যবসায়ী।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাস-২০২৩ সালের
জুলাই ও আগস্টে ঋণের সুদহার ছিল যথাক্রমে ৭ দশমিক ১০ ও ৭ দশমিক ১৪ শতাংশ।
এরপর সেই বছরের সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে সুদহার বাড়িয়ে যথাক্রমে ৭ দশমিক ২০ ও
৭ দশমিক ৪৩ শতাংশ করা হয়। নভেম্বর ও ডিসেম্বর ২০২৩-এ এটি বাড়িয়ে যথাক্রমে ৭
দশমিক ৭২ ও ৮ দশমিক ১৪ শতাংশ করা হয়। চলতি বছরের জানুয়ারির শেষে
বেঞ্চমার্ক সুদের হার ছিল ৮ দশমিক ৬৮ শতাংশ। ফেব্রুয়ারিতে তা ছিল ৯ দশমিক
৬১ শতাংশ এবং মার্চে তা লাফিয়ে ১০ দশমিক ৫৫ শতাংশ হয়েছে।
ব্যাংকগুলোকে তাদের ঋণের সুদ নির্ধারণের জন্য স্মার্ট হারের সঙ্গে আরো ৩
শতাংশ পর্যন্ত যোগ করার অনুমতি দেয়া হয়েছে। আগে ব্যাংকগুলোকে বেঞ্চমার্ক
হারের সঙ্গে ৩ দশমিক ৫০ শতাংশ যোগ করার অনুমতি দেয়া হয়েছিল।