[ পাতা ৪ ] 04/05/2024 |
|
|
|
একীভূতকরণে দুর্বল ব্যাংকের ইচ্ছা-অনিচ্ছা |
|
|
ব্যাংকিং ব্যবস্থায় সংস্কার আনার জন্য সরকার কিছু যুগোপযোগী কার্যক্রম গ্রহণ করতে যাচ্ছে। এই কার্যক্রমের অংশ হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। ব্যাংক কোম্পানি একীভূতকরণের উদ্যোগ কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্তৃক গৃহীত ওই পদক্ষেপেরই অংশ। ইতোমধ্যে পত্রিকার মাধ্যমে আমরা জেনেছি, সিটি ব্যাংকের সঙ্গে বেসিক ব্যাংক এবং ইউনাইটেড কর্মাশিয়াল ব্যাংকের সঙ্গে ন্যাশনাল ব্যাংকের একীভূতকরণের সিদ্ধান্ত বা প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। কিন্তু সম্প্রতি জানা গেল, সিটি ব্যাংকের সঙ্গে বেসিক ব্যাংক একীভূত হতে চায় না। ন্যাশনাল ব্যাংকও একীভূত না হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আজকের নিবন্ধের মূল উদ্দেশ্য হলো ব্যাংক একীভূতকরণ নিয়ে এ দুটো ব্যাংকের ইচ্ছা-অনিচ্ছার সুফল ও কুফল নিয়ে আলোচনা করা।
শুরুতে বলে রাখা দরকার, আমাদের দেশে ৬১টি ব্যাংক আছে। সঠিকভাবে পরিচালনা করলে সব ব্যাংকেরই এখনও ভালো চলার সুযোগ আছে। কারণ, দেশে এখনও পর্যাপ্ত ঋণের চাহিদা আছে। কিন্তু ব্যাংক খাতের কিছু অসাধু মানুষ নিজ দায়িত্ব পালন না করে ব্যক্তিগত সুযোগ-সুবিধা আদায়ে ব্যস্ত সময় কাটায়। ফলে দেশের আর্থিক খাত আজ সমস্যার সম্মুখীন। এ পরিস্থিতিতেই ব্যাংক একীভূতকরণের প্রস্তাব উঠেছে। একই সঙ্গে এ কথাও বলা দরকার, একীভূত হতে উল্লিখিত অনিচ্ছার ব্যাপারে দুই ব্যাংকের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের মধ্যে ভিন্নতা রয়েছে।
প্রথমেই আসি সরকারি বেসিক ব্যাংক বিষয়ে। ব্যাংকটি কোনো বেসরকারি ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হতে চায় না। তারা অন্য সরকারি ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হতে চায়। এর পক্ষে তাদের যুক্তি হলো, বেসরকারি ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার সিদ্ধান্তে আমানতকারীরা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে বেসিক ব্যাংক থেকে তাদের টাকা তুলে নিচ্ছেন। কিন্তু বেসিক ব্যাংক দুর্বল থাকা অবস্থায় আমানতকারীরা আমানত তুলে নেননি। যখন সিটি ব্যাংকের মতো ভালো ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হওয়ার ঘোষণা এলো, ঠিক তখনই আমানত তুলে নেওয়ার হিড়িক পড়ে গেল– এটা কোনো যুক্তির কথা হতে পারে না। একটি দুর্বল ব্যাংক ভালো ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার উদ্দেশ্য হলো দুর্বল বা টার্গেট ব্যাংকের সম্পদ ও দায় গ্রহণ করে ভালো ব্যাংকটি টার্গেট ব্যাংকের সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করবে। এতে গ্রাহক ও আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষা হবে। এখানে আতঙ্কগ্রস্ত হওয়ার কিছু নেই। যদি কোনো আতঙ্ক তৈরি হয়েই থাকে, তার কারণ হলো, তারা একীভূতকরণের সুফল সম্পর্কে তাদের গ্রাহক ও আমানতকারীদের অবহিত করার কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।
বেসিক ব্যাংক ২০১৫ সাল থেকে সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা থেকে ডিপোজিট পেয়ে আসছে। এত বড় সুযোগ থাকার পরও যে ব্যাংকের এই দুর্দশা, তাদের কি কোনো ইচ্ছা-অনিচ্ছা থাকতে পারে? তাদের ধারণা, সরকারি ব্যাংকে থাকলে লোকসান হোক আর যাই হোক, সবার চাকরি বহাল থাকবে; বেতন-ভাতার কোনো সমস্যা হবে না। যতটুকু জানা যায়, ২০০৯ সালে ব্যাংকটির জনবল ছিল ৭৭৬ জন। ২০১৪ সালে এ সংখ্যা দুই হাজার ছাড়িয়ে যায়। এখনও এ ব্যাংকের জনবল দুই হাজারের বেশি। ফলে অপরিকল্পিতভাবে ব্যাংকটির শাখা খুলে এর কলেবর বৃদ্ধি আর মোটা অঙ্কের লোকসান করা হয়। এবার আসা যাক বেসরকারি ন্যাশনাল ব্যাংক প্রসঙ্গে। আমরা জানি, ন্যাশনাল ব্যাংক দেশের প্রথম প্রজন্মের একটি বেসরকারি ব্যাংক। সম্প্রতি ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক নতুন পরিচালনা পর্ষদ গঠন করে দিয়েছে। যতদূর জানি, ব্যাংকটির নতুন চেয়ারম্যান একজন দক্ষ মানুষ। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএর শিক্ষক ছিলেন। অন্যান্য পরিচালকও বেশ দক্ষ এবং ব্যাংকটির মঙ্গল করার জন্য তাদের দৃঢ় প্রতিশ্রুতি রয়েছে। নতুন ব্যবস্থাপনা পরিচালক দায়িত্ব নিয়ে পর্ষদের নির্দেশনা অনুযায়ী নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। এরই মধ্যে বেশ কিছু খেলাপি ঋণ আদায়ও করেছেন। এই পর্যায়ে ন্যাশনাল ব্যাংক একীভূত না হয়ে ঋণ আদায় জোরদারসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়ে নিজেদের অবস্থার উন্নতি করার চ্যালেঞ্জ নিতে চায়। আমি একজন নাগরিক হিসেবে তাদের এ সিদ্ধান্তকে এক বাক্যে স্বাগত জানাই। তারা ব্যাংকের মূল সমস্যা চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে আগ্রহী। সে অনুযায়ী তারা প্রথমেই খেলাপি ঋণ আদায়ের ব্যাপারে মনোযোগী হচ্ছেন। আমি একজন করপোরেট আইনজীবী হিসেবে আমার নগণ্য অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, সদিচ্ছা থাকলে সিংহভাগ খেলাপি ঋণ আদায় করা অবশ্যই সম্ভব।
একীভূতকরণ বিষয়ে বেসিক ব্যাংক আর ন্যাশনাল ব্যাংকের অনিচ্ছা নিয়ে পর্যালোচনা করলে প্রতীয়মান হয়, বেসিক ব্যাংক তাদের দুর্দশার বোঝা আবারও সরকারের কাঁধে দিয়ে নিজেদের সুযোগ-সুবিধা চলমান রাখতে চায়। এ জন্য সরকারি স্বার্থ রসাতলে গেলেও তাদের মাথাব্যথা নেই। অন্যদিকে ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ এবং ব্যবস্থাপনা টিম নিজেরাই ঘুরে দাঁড়ানোর চ্যালেঞ্জ গ্রহণের প্রত্যয় ঘোষণা করেছে। তাদের এই মনোভাব সব মহলেই প্রশংসিত হবে বলে আমি মনে করি। আমি নিজেও চ্যালেঞ্জ নিতে পছন্দ করি। কারণ চ্যালেঞ্জের ক্ষেত্রগুলোতে প্রতিযোগিতা কম। বেশির ভাগ মানুষ বেসিক ব্যাংকের মতো ডিফেন্সিভ অবস্থানে থাকতে পছন্দ করে বা সহজ কাজটিই বেছে নেয়। এই ডিফেন্সিভ অবস্থানে থেকে কোনোমতে টিকে থাকা যায়, কিন্তু বেশি দূর যাওয়া যায় না। সফল হতে হলে ন্যাশনাল ব্যাংকের বর্তমান পরিচালনা পর্ষদের মতো অফেন্সিভ চ্যালেঞ্জে যেতে হবে।
তবে চ্যালেঞ্জ গ্রহণের পর দ্রুত কার্যক্রম গ্রহণ করা আবশ্যক। আমাদের প্রত্যাশা, ন্যাশনাল ব্যাংকের ম্যানেজমেন্ট ও পরিচালনা পর্ষদ এই দুর্বল ব্যাংকটির মধ্যে নতুন প্রাণের সঞ্চার, খেলাপি ঋণ আদায়, সুশাসন প্রতিষ্ঠা, দায়বদ্ধতার সংস্কৃতি চালু করে এমন একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে, যা ব্যাংক শিল্পে অনুকরণীয় হয়ে থাকবে।
ড. মো. তাবারক হোসেন ভূঁঞা: হেড অব চেম্বার, জুরিসকনসাল্টস অ্যান্ড লিগ্যাল সলিউশনস (জেএলএস) |
News Source
|
|
|
|
|
|
|
|
Today's Other News
|
Related Stories |
|
|
|
|