Hawkerbd.com     SINCE
 
 
 
 
ভুয়া সনদধারীরা এখন কে কোথায়? [ Online ] 08/05/2024
ভুয়া সনদধারীরা এখন কে কোথায়?
 ড. মো. ফখরুল ইসলাম

নকল, ভেজাল, ভুয়া, জাল, প্রতারণা ইত্যাদি শব্দ আজকাল সবার গা-সওয়া হয়ে গেছে। পরীক্ষায় নকল, জমির দলিল জাল করা ইত্যাদি তথ্য বহু আগে থেকে মানুষ জানত। ওজনে কম দেওয়া, খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল মেশানো, বিশেষ করে দুধের মধ্যে পানি কিংবা চালের মধ্যে কঙ্কর মিশিয়ে বিক্রি করার প্রবণতাও অনেক পুরোনো। তবে সেগুলোর মধ্যে একটা ‘ঢাক ঢাক গুড় গুড়’ অবস্থা বিরাজ করত। পড়াশোনা ও প্রতিযোগিতা করে সনদ লাভ করা অনেকটা কঠিন ও পবিত্র বিষয় মনে করা হতো। কিন্তু দুর্বৃত্তরা ভুয়া সনদ তৈরি ও বিক্রির মাধ্যমে একদিকে মানুষের চিরায়ত প্রচেষ্টার প্রাচীর ভেঙে দিয়েছে, অন্যদিকে প্রাণসংহারী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে।

যাত্রীকল্যাণ সমিতির সড়ক দুর্ঘটনা মনিটরিং সেলের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ বছর রোজার ঈদযাত্রায় ১৫ দিনে সড়ক, রেল ও নৌপথে ৪২৯টি দুর্ঘটনায় ৪৩৮ জন মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। এর মধ্যে ৪০ শতাংশই মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা। ১৯৮টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ১৬০ জন প্রাণ হারিয়েছেন। দেশের সড়কে ৬ লাখ ফিটনেসবিহীন গাড়ি অবৈধভাবে চলাচল করছে বলে সংবাদ শিরোনাম হয়েছে। মারাত্মক দুর্ঘটনা কবলিত যানবাহনগুলোর কারও ড্রাইভিং সনদ নেই, কারও কারও ফিটনেস নেই। যাদের আছে সেগুলো মেয়াদোত্তীর্ণ অথবা জাল। দেশে বিভিন্ন ধরনের জাল সনদ তৈরির কারখানার সন্ধান পাওয়া গেছে বহু আগে, যেগুলোতে শুধু জাল ড্রাইভিং সার্টিফিকেটই নয়, জাল পাসপোর্ট, ভিসা এবং অতি ভালো ফলাফল সংবলিত নম্বরপত্র ও সনদ তৈরি হতো।

সম্প্রতি রাজধানী ঢাকার পীরেরবাগে ভুয়া একাডেমিক সনদ তৈরির কারখানার সন্ধান পাওয়া গেছে। জাল সনদ তৈরি ও বিক্রির অভিনব প্রক্রিয়া ও অনেক চমকপ্রদ তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের একজন সিস্টেম অ্যানালিস্টকে হাতেনাতে ধরা হয়েছে জাল সনদ তৈরি ও বিক্রির অভিযোগে। শিক্ষা বোর্ড থেকে সরকারি সনদ ছাপানোর কাগজ বাসায় এনে বাসায় বসেও জাল সনদ তৈরি করতেন তিনি! ৩৫ হাজার টাকার নিচে কোনো সনদ বিক্রি করতেন না। চাহিদামতো ফলাফল প্রদানের ধরন-মান অনুযায়ী সনদের মূল্য ওঠানামা করত। ভুয়া ফলাফল তৈরি করে সরকারি শিক্ষা বোর্ডের অনলাইন সার্ভারে আপলোড করতেন তিনি।

আরও ভয়ংকর তথ্য দিয়েছেন তিনি, যা হলো তার মাধ্যমে এ পর্যন্ত ৫ হাজার ৫০০ জাল সনদ বিক্রি হয়েছে। এসব তৈরিতে শিক্ষা বোর্ডের বিশাল চক্র জড়িত। সনদ তৈরি করার পর সেগুলোতে ডিজিটাল স্বাক্ষর সেঁটে দেওয়া হতো। মূল সনদ বা নম্বরপত্রের প্রতিটিতে দায়িত্বশীল কর্মকর্তার হাত-কলমে লেখা সই ও তারিখের ক্ষেত্রে কী করা হতো এবং সেটার ভ্রান্তি যাচাইয়ের দায়িত্বে থাকা কর্মচারীদের কাঁচা সই দেওয়ার নিয়মের ক্ষেত্রে কী করা হতো-এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে নীরব থেকেছেন তিনি। এর অর্থ দাঁড়ায়, সার্টিফিকেট জালিয়াতিতে শিক্ষা বোর্ডের ছোট-বড় অনেকেই জড়িত। সবাইকে ম্যানেজ করে তিনি সরকারি কাগজ বের করে বাসায় আনতেন। এসব বিষয়ে অনেক সাংবাদিকও তথ্য জানতেন, সুবিধা নিতেন বলে সংবাদ হয়েছে!

পরীক্ষার সনদ জাল করা এবং পেশাদারি সনদ ভেজাল করে চোখে ধুলা দেওয়ার যে সংস্কৃতি চালু হয়েছে তার শেষ কোথায়? ৫ হাজার ৫০০ জাল একাডেমিক সনদ বিক্রি হয়ে গেলে সেসব ভুয়া সনদধারী ব্যক্তিরা এখন কোথায় কী কাজ করছেন, তা জানা আরও বেশি জরুরি। তারা কি কোনো চাকরি করছেন? কোথায় হয়েছে ভুয়া সনদধারীদের চাকরি? তথ্য বিশ্লেষণে জানা গেছে, এসব ভুয়া সনদধারীর অনেকে দেশের গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হয়েছেন হীন রাজনৈতিক তদবিরের মাধ্যমে। অনেকে বিদেশে পড়তে বা চাকরি করতে চলে গেছেন মামা-চাচাদের অবৈধ অর্থের জৌলুসকে পুঁজি করে। অনেকে নামিদামি বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেলে দেশেই পড়াশোনা করছেন। তাহলে আর রক্ষা কোথায়? এতসব বিষয় তদন্ত করে দেখার মতো সক্ষমতা, পেশাদারিত্ব ও ধৈর্য কোনো সংস্থার আছে?

অনেকে বলতে পারেন, জাল-ভুয়া-ভেজাল নেই কোথায়? হ্যাঁ, তা অবশ্য আছে। সমাজের সব জায়গা জালিয়াতিতে ভরে গেছে। সেখানে আলাদা করে এতসব দুর্নীতিকে স্টাডি করে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হলে আলাদা মন্ত্রণালয় তৈরি করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ক্রিমিনোলজি ও মানবসৃষ্ট দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা পড়ানো ও শেখানো হয়। এগুলো নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকারি সংস্থা আছে। কিন্তু সেসব সংস্থা দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে একে অপরের ওপর নির্ভরশীল থাকায় স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে না। ফলে কাজে নেমে পদে পদে বাধা নিয়ে থমকে থাকতে হয়। বিশেষ করে চতুর্মুখী রাজনৈতিক চাপ তাদের মাঝপথে গতিও ‘ফিউজ’ করে দেয়। এটাই এখন সংস্কৃতি!

অবৈধ রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ এসব দুর্নীতির তদন্তের গতিকে স্তব্ধ করে দেয়। সড়কে বারবার মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনা এসব হস্তক্ষেপের ফলেই ঘটছে। হালনাগাদ ফিটনেস নেই, রুট পারমিট নেই, অথচ সড়কে ছয় লাখ অবৈধ গাড়ি চলছে। এসবের মালিক কারা? এসব যানবাহন মহাসড়কে চলাচলের অনুমতিদাতা কারা? মুখে নীতির কথা বলে এক জায়গায় আমরা নতজানু হয়ে একাকার হয়ে যাচ্ছি; সেটা হলো অবৈধ উপায়ে মানুষের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করা এবং জীবন বাজি রেখে অর্থ উপার্জনে নিয়োজিত হওয়া। এটা করতে গিয়ে দুর্নীতিকে উসকে দেওয়া হচ্ছে প্রতিদিন। এই একটি বিষয়ই আমাদের বেশি শৃঙ্খলাহানি করছে।

ক্রমাগত শৃঙ্খলাহানির ফলে ওদের চোখের সামনেই চলছে শুধু বডি রং করা ফিটনেসবিহীন ও অবৈধ মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ি। এসব গাড়িকে পাকড়াও করার কথা যাদের, তারা আগেই সংকেত পেয়ে চোখ বুঁজে থাকেন। আধুনিক সিসি ক্যামেরা বসানো থাকলেও সেখানে রেকর্ড বন্ধ করে রাখা হয় অথবা ডিস্ক বা ডিজিটাল সিস্টেম নষ্ট বলে অজুহাত দেখানো হয়। অথচ আজকাল ডিজিটাল সিস্টেমে ঘরে বা অফিসে বসেই নির্ধারণ করা যায় রাস্তায় কার কতটা গাড়ি কীভাবে চলাচল করছে। আমরা বহু অর্থ খরচ করে সিগন্যাল বাতি বা সিসি ক্যামেরা কিনে আনলেও তা রাস্তায় লাগালেই অদৃশ্য কারণে বন্ধ থাকে। আমাদের সচল ডিজিটাল মেশিনেও অবৈধ গাড়ি ধরা পড়ে না। অথচ হিসাবের খাতায় খরচ দেখিয়ে বাজেট বাড়ানো হয়ে যায়। আধুনিক ও প্রশস্ত ফোর বা সিক্স লেনের রাস্তা বানালেও সড়কে দুর্ঘটনা কমে না।

সেদিন দেখলাম, এক ভিক্ষুক প্রচণ্ড গরমের মধ্যে দড়িতে পা বেঁধে রাজপথে বস্তা গায়ে গড়াগড়ি দিয়ে শুয়ে থালা পেতে ভিক্ষা করছে। নিকটস্থ এক দোকানি দীর্ঘ সময় সেটা পর্যবেক্ষণ করে তাকে সেখান থেকে চলে যেতে বললে সে রাজি হলো না। কিন্তু একটি লাঠি হাতে তাড়া করতেই সেই ভিক্ষুক উঠে দৌড়ে পালিয়ে গেল। এদের সঙ্গে উচ্চপর্যায়ের দুর্নীতিবাজ ও মেগা-অপরাধীদের অমিল কোথায়? মিল এক জায়গায় অবশ্যই আছে, তা হলো, ভিক্ষুকরা ভিক্ষার পয়সা দিয়ে চাঁদা দেয় মাস্তানদের। আর বড় অপরাধীরা বড় অঙ্কের ঘুস দিয়ে মুখ বন্ধ করে দেশের নীতিনির্ধারকদের।

আসলে ছোট-বড়, ভদ্র, স্মার্ট-সব দুর্নীতিবাজ এক জায়গায় একাকার হয়ে গেছে। তা হলো, অবৈধ উপায়ে অর্থ অর্জন। স্বজনপ্রীতি, ঘুস, চাঁদাবাজি, জালিয়াতি, চুরি, ভেজালকরণ ইত্যাদি যেন সবার মজ্জাগত ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে সংবাদ শিরোনাম হলেও তাদের বিরুদ্ধে তদন্তে দুদকের ধীরগতির কথা সংবাদে প্রকাশ পাচ্ছে। ‘হোয়াইট কলার ক্রিমিনালদের’ পক্ষে রাজনৈতিকভাবে একপেশে ও দলকানা নীতিও সাড়ম্বরে চালু হয়ে গেছে। এতে অপরাধীরা আরও বেশি আস্কারা পেয়ে এ ধরনের দুর্নীতি করতে বেপরোয়া হয়ে উঠছে।

দেশে জাল সনদ বিক্রেতাদের একটি সামান্য অংশ ধরা পড়লেও সেসব চোর বা ভুয়া সনদধারী এখন কোথায়, তা শনাক্ত করা জরুরি হয়ে পড়েছে। সবকিছুতেই গা-সওয়ানো যায় না। ভুয়া, নকল, ভেজাল মানুষের গায়ে সহ্য না হলেও রাজনৈতিক বক্তৃতার মাধ্যমে এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও গণমাধ্যমের কল্যাণে এ শব্দগুলো সর্বজনীন হয়ে পড়েছে।

যাদের ছত্রছায়ায় রাঘববোয়ালরা মানুষের কল্যাণ হরণে আড়ালে বসে সবসময় কলকাঠি নাড়ছে, তাদের সন্ধান কি কোনোদিনই পাওয়া যাবে না? তাদের কি কখনো পাকড়াও করা যাবে না? তাই এখন শুধু অপেক্ষা, এসব সড়ক বা সনদ সম্পর্কিত মেগা-অপরাধমূলক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয় তা দেখার।

ড. মো. ফখরুল ইসলাম : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের অধ্যাপক ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন
News Source
 
 
 
 
Today's Other News
More
Related Stories
 
Forward to Friend Print Close Add to Archive Personal Archive  
Forward to Friend Print Close Add to Archive Personal Archive  
 
 
Home / About Us / Benifits / Invite a Friend / Policy
Copyright © Hawker 2013-2012, Allright Reserved