[ Page 16 ] 24/12/2022
 
চলছে অবৈধ জমি বেচাকেনা গড়ে উঠেছে শত শত বাড়ি
-উজ্জ্বল বিশ্বাস, বাঁশখালী (চট্টগ্রাম)

চট্টগ্রামের বাঁশখালীর নাপোড়া বন বিট ঘুরলে মনে হবে না যে এটা সংরক্ষিত বনাঞ্চল। জীববৈচিত্র্য আর গাছপালার প্রাচুর্যের বদলে চোখে পড়বে চার-পাঁচতলা পাকা দালান, সেমিপাকা বা টিনশেড ঘর, শত শত খুঁটিতে বৈদ্যুতিক সঞ্চালন লাইন। এ যেন বন ধ্বংস করে মানববসতি গড়ে তোলার এক যজ্ঞ।

মানুষের নির্বিচার পদচারণ আর বৈদ্যুতিক আলোর ঝলকানিতে নিশিজাগা বনের নানা জীবজন্তু ও পাখপাখালির অস্তিত্ব প্রায় বিলীন।

পানি আহরণে পাহাড়ের শিরোভাগে নলকূপ বসানোয় বর্ষা মৌসুমে প্রাকৃতিক ঝরনাগুলোতে উচ্ছল পানির ধারা আর দেখা যাচ্ছে না।

সরেজমিনে ঘুরে জানা গেছে, বন কর্মকর্তাদের যোগসাজশে সংরক্ষিত এই বনাঞ্চলের জমি ৩০০ টাকার স্ট্যাম্পে লিখে বিক্রি করছেন স্থানীয় ‘চিহ্নিত কিছু দখলদার’। তাঁরা দখলি স্বত্ব দেখিয়ে বনের জায়গা আগ্রহী ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করছেন। স্বত্বের বিষয়টি বিশ্বাসযোগ্য করতে তাঁরা সাক্ষী হিসেবে স্থানীয় ইউপি সদস্যদের স্বাক্ষর নিচ্ছেন ওই কাগজে।
বেসরকারি এক জরিপের তথ্য অনুযায়ী, শুধু নাপোড়া বন বিটেই গড়ে উঠেছে তিন হাজারের বেশি অবৈধ ঘরবাড়ি। প্রতিটি ঘরে রয়েছে সংরক্ষিত বনাঞ্চলের জমি কেনার ৩০০ টাকার স্ট্যাম্পে করা দলিল। এসব এলাকার বেশির ভাগ মানুষ কুতুবদিয়া, পেকুয়া, মহেশখালী ও বাঁশখালী উপজেলার ছনুয়া, গণ্ডামারা, শেখেরখিল এলাকার বাসিন্দা। নাপোড়া ভিলেজারপাড়ায় ৩০০ টাকার স্ট্যাম্পে এমন একটি জমি কেনাবেচার তথ্য মিলেছে। ওই স্ট্যাম্পে দেখা গেছে, নাপোড়া ভিলেজারপাড়ার রফিকুল ইসলামের ছেলে সাহাব উদ্দিন সংরক্ষিত বনাঞ্চলের আট শতক জমি চার লাখ টাকায় বিক্রয় করেন। কিনেছেন ছনুয়ার খুদুকখালী গ্রামের ছালেহ আহমের স্ত্রী লুত্ফা বেগম। ওই জায়গায় তিনি পাকা দালান তৈরি করছেন। পাহাড়ের ওপর নলকূপও বসিয়েছেন।

লুত্ফা বেগম বলেন, চার লাখ টাকায় জায়গা কেনার পর বন কর্মকর্তারা এসে দেখে গেছেন। ৩০ হাজার টাকা নিয়ে চলে যান তাঁরা। বাড়ি করলে কোনো অসুবিধা হবে না বলে আশ্বাস দেন।

পাশেই একই রকম চুক্তিতে পাকা দালান করেছেন জাফর আহমদের স্ত্রী মনোয়ারা বেগম, কাঠ ব্যবসায়ী ছৈয়দ আহমদ সওদাগর দুদু মিয়ার ছেলে নুরুল ইসলাম, কুতুবদিয়ার উত্তর ধুরং গ্রামের জয়নাল আবেদীনের ছেলে জাহেদুল সিকদার। এভাবে রাতারাতি শত শত বাড়ি বনাঞ্চলে আবাসিক প্রকল্পে গড়ে উঠছে।

অভিযোগ রয়েছে, সংরক্ষিত বনাঞ্চলের জমি বিক্রয়ে স্থানভিত্তিক লোক নিয়োগ করেছেন খোদ বন কর্মকর্তারাই। নাপোড়া বন বিট এলাকায় ‘বনখেকো’ হিসেবে সাহাব উদ্দিন ও জামাল হোসেন ওরফে হোসেনের নাম মানুষের মুখে মুখে। স্থানীয় বন কর্মকর্তাদের সঙ্গে তাঁদের চলাফেরা। নাপোড়া বন বিটের অদূরে সংরক্ষিত বনেই ১৬ শতক জায়গার ওপর বন কর্মকর্তাদের দেওয়া পদবিধারী ভিলেজার হেডম্যান জামাল হোসেন তৈরি করছেন পাঁচতলা বাড়ি।

স্থানীয় অনেকের অভিযোগ, বন কর্মকর্তাদের যোগসাজশে বনাঞ্চলের জমি, পাহাড়ের মাটি, গাছ, বাঁশ, ছড়ার বালি বিক্রিতে সাহাব উদ্দিন ও জামাল হোসেনের বিশাল চক্র গড়ে উঠেছে।

গ্রামবাসীর অভিযোগ, বনাঞ্চলের জমি যারা কেনে, তাদের বিরুদ্ধে বন বিভাগ মামলা করলেও বিক্রেতাদের কারো বিরুদ্ধে তারা মামলা করে না। এসব মামলায় জমির ক্রেতা-বিক্রেতা কারো কিছু হয় না। বন বিভাগের দুর্বল বর্ণনা ও ব্যাখ্যায় অগোছালো মামলায় আদালতে গেলে জমি কেনা ব্যক্তিদের জামিন হয়ে যায়।

বিক্রেতা সাহাব উদ্দিন বলেন, ‘বন বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে সম্পর্ক আছে বলেই আমি জায়গা বিক্রয় করেছি। ওই টাকার ভাগ বন কর্মকর্তা ও ইউপি সদস্য সুজিত কান্তি বৈদ্যও নিয়েছেন। স্ট্যাম্পেও ১ নম্বর সাক্ষী ইউপি সদস্য সুজিত কান্তি। ’
ভিলেজার হেডম্যান জামাল হোসেন বলেন, ‘আমি ভিলেজার হেডম্যান। সংরক্ষিত বনাঞ্চলে শত শত বাড়ি উঠেছে। আমি হেডম্যান হয়ে বাড়ি করার অপরাধে যদি বন কর্মকর্তারা মামলা করেন, তাহলে আগে সবার বিরুদ্ধে মামলা করতে হবে। ’

পুঁইছড়ি ইউনিয়নের নাপোড়া ৮ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য সুজিত কান্তি বৈদ্য বলেন, ‘বনাঞ্চলের জায়গা অনেকেই কেনাবেচা করছে। আমি স্বাক্ষর করলে অপরাধ কিসের? ক্রেতা চুক্তিনামাটা মজবুত করতে আমার স্বাক্ষর নিয়েছে ১ নম্বর সাক্ষী হিসেবে। এতে আমি কোনো টাকা নিইনি। ’

বন বিভাগের নাপোড়া বন বিট কর্মকর্তা মো. মিজান বলেন, ‘নাপোড়ার বনাঞ্চল নাপোড়া বন বিট ও চাম্বল বন বিট নামের দুই বন বিটের অধীনে। অবৈধ বসতবাড়ি নির্মাণকারীদের বিরুদ্ধে মামলা করি। কিন্তু আদালত রায় না দিলে তো কিছুই করতে পারি না। বনখেকোদের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। কিছু মানুষ বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। ’

বন বিভাগের জলদী রেঞ্জের রেঞ্জ কর্মকর্তা (জলদী বিট, চাম্বল বিট, নাপোড়া বিট ও পুঁইছড়ি বিট তদারককারী) আনিচ্ছুজ্জামান শেখ বলেন, গোটা প্রশাসনকে নিয়ে সমন্বিত উচ্ছেদ অভিযান না চালানো পর্যন্ত বনখেকোদের দমন করা যাবে না। বনখেকোদের ব্যাপারে ওপরমহলে জানানো হয়েছে।

বনের ভেতর বিদ্যুৎ সরবরাহ লাইন দেওয়ার বিষয়ে বাঁশখালী পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির উপমহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) যীশু কুমার ঘোষ বলেন, সাধারণত জমির খতিয়ান ও নামজারির কাগজ দেখে বিদ্যুৎ দেওয়া হয়; কিন্তু বনের ভেতর বাড়িঘরে বিদ্যুৎ দেওয়া হয়েছে ৩০০ টাকার স্ট্যাম্পে লেখা দলিল দেখে। এখানে কিছু চাপও আছে। তবে চাপের বিষয়ে তিনি স্পষ্ট করে কিছু বলেননি।