[ অনলাইন ] 17/04/2024
 
এলডিসি উত্তরণের পর শুল্ক বাধায় পড়বে রপ্তানি খাত
স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বাংলাদেশ বের হবে ২০২৬ সালের শেষ নাগাদ। তবে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার পরই বড় ধরনের শুল্ক বাধায় পড়তে যাচ্ছে রপ্তানি খাত। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া আর কোনো দেশে পণ্য রপ্তানিতে শুল্ক দিতে হয় না। তবে এলডিসি থেকে উত্তরণের পর যুক্তরাজ্য ছাড়া প্রায় সব বাজারেই পণ্য রপ্তানিতে দিতে হবে শুল্ক। এতে রপ্তানি খাত বড় ধরনের ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) সম্প্রতি প্রকাশিত ‘এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট আউটলুক: এপ্রিল ২০২৪’ প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। এতে ২০২২-২৩ অর্থবছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের রপ্তানি খাতের অংশ, সেসব বাজারে বর্তমান শুল্কহার এবং এলডিসি উত্তরণের পরের সম্ভাব্য শুল্কহার তুলে ধরা হয়েছে। এর ভিত্তিতে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) ২০২২ সালের প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, এলডিসি উত্তরণের পর বাংলাদেশের রপ্তানি আয় ১৪ শতাংশ কমে যাবে।

প্রতিবেদনের তথ্যমতে, ২০২২-২৩ অর্থবছর বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের ৪৫ দশমিক ৪০ শতাংশই ছিল ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত (ইইউ) দেশগুলো থেকে। এ দেশগুলোয় পণ্য রপ্তানিতে বর্তমানে বাংলাদেশের কোনো ধরনের শুল্ক দিতে হয় না। তবে এলডিসি থেকে উত্তরণের পর ওই বাজারে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানিতে ১২ শতাংশ শুল্ক দিতে হবে। তবে ইইউতে রপ্তানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেক বছর ধরেই জিএসপি প্লাস সুবিধা চেয়ে আসছে। এ সুবিধা পেলে এলডিসি থেকে উত্তরণের পর ৬৬ শতাংশ শুল্কমুক্ত সুবিধা পাবে বাংলাদেশ। এতে ইইউতে রপ্তানির ক্ষেত্রে ১২ শতাংশের পরিবর্তে মাত্র চার শতাংশ শুল্ক দিতে হবে।

বাংলাদেশের রপ্তানির অন্যতম বৃহৎ বাজার যুক্তরাষ্ট্র। যদিও সেখানে বাংলাদেশ কোনো ধরনের শুল্কমুক্ত সুবিধা পায় না। ২০২২-২৩ অর্থবছর দেশটিতে বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের সাড়ে ১৭ শতাংশ গেছে। ওই বাজারে বর্তমানে ১৫ শতাংশ হারে শুল্ক দিতে হয়, যা এলডিসি থেকে উত্তরণের পরও বহাল থাকবে। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের কাছে অনেক বছর ধরেই শুল্কমুক্ত পণ্য রপ্তানির সুবিধা চেয়ে আসছে বাংলাদেশ। তবে দেশটি এ বিষয়ে এখনও সাড়া দেয়নি।

২০২২-২৩ অর্থবছর বাংলাদেশের তৃতীয় বৃহৎ রপ্তানির গন্তব্য ছিল যুক্তরাজ্য। ওই বছর রপ্তানি আয়ের ৯ দশমিক ৬০ শতাংশ এসেছে দেশটি থেকে। রপ্তানির এ বাজারে বর্তমানে শুল্কমুক্ত সুবিধা পায় বাংলাদেশ। এলডিসি থেকে উত্তরণের পরও ২০২৯ সাল পর্যন্ত এ সুবিধা বহাল থাকছে। তৈরি পোশাকসহ ৯২ শতাংশ পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা বহাল রাখবে যুক্তরাজ্য। তবে দেশটি রুলস অব অরিজিনের ক্ষেত্রে আরও কঠোর হবে। যদিও ২০৩২ সাল পর্যন্ত এ সুবিধা বর্ধিত করার জন্য যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনারের কাছে চিঠি দিয়েছে তৈরি পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ।

এডিবির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২২-২৩ অর্থবছর বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে পরের অবস্থানে ছিল প্রতিবেশী দেশ ভারত। দেশটিতে ওই অর্থবছর রপ্তানি পণ্যের তিন দশমিক ৮০ শতাংশ গেছে। বর্তমানে ভারতে পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে শুল্কমুক্ত সুবিধা পায় বাংলাদেশ। তবে এলডিসি থেকে উত্তরণের পর এ বাজারে শুল্ক দিতে হবে আট দশমিক ৬১ শতাংশ হারে।

অনেকটা একই ধরনের চিত্র জাপানের ক্ষেত্রেও। দেশটিতে ২০২২-২৩ অর্থবছর রপ্তানি পণ্যের তিন দশমিক ৪০ শতাংশ গেছে। বর্তমানে জাপানে রপ্তানির ক্ষেত্রে ৯৮ শতাংশ পণ্যেই শুল্কমুক্ত সুবিধা পায় বাংলাদেশ। তবে এলডিসি থেকে উত্তরণের পর এ বাজারে শুল্ক দিতে হবে আট দশমিক ৭১ শতাংশ হারে। আর কানাডায় ২০২২-২৩ অর্থবছর রপ্তানি পণ্যের তিন দশমিক ১০ শতাংশ গেছে। বর্তমানে দেশটিতে পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে শুল্কমুক্ত  সুবিধা পায় বাংলাদেশ। তবে এলডিসি থেকে উত্তরণের পর এক্ষেত্রে শুল্ক দিতে হবে ১৭ শতাংশ হারে।

এদিকে বর্তমানে চীনে বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের খুবই সামান্যই যায়। ২০২২-২৩ অর্থবছর দেশটিতে রপ্তানি পণ্যের মাত্র এক দশমিক ২০ শতাংশ গেছে। বর্তমানে চীনে রপ্তানির ক্ষেত্রে ৯৮ শতাংশ পণ্যেই শুল্কমুক্ত সুবিধা পায় বাংলাদেশ। তবে এলডিসি থেকে উত্তরণের পর এ বাজারে শুল্ক দিতে হবে ১৬ দশমিক ২০ শতাংশ হারে। এলডিসি থেকে উত্তরণের পর এভাবেই শুল্কারোপ বাংলাদেশের রপ্তানিকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।

এডিবি বলছে, এলডিসি থেকে উত্তরণের পর অনেক আন্তর্জাতিক সহায়তা হ্রাস পাবে। এ উত্তরণ তিন ধরনের প্রভাব ফেলবে, যা বাংলাদেশের রপ্তানি আয় ও বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ হ্রাস করবে। তিনটি প্রভাবের প্রথমটি হলো, ডব্লিউটিওর বিশেষ চুক্তির আওতায় পাওয়া বিভিন্ন দেশের নীতিগত ছাড় বাতিল হয়ে যাবে। এলসিডি উত্তরণ ডব্লিউটিওর আওতায় থাকা নীতিসহায়তার ছাড় সীমিত করবে বিভিন্ন দেশ। এছাড়া ডব্লিউটিওর নীতিমালার আওতায় রপ্তানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে ভর্তুকি বন্ধ করতে হবে।

এলডিসি উত্তরণের ফলে বাংলাদেশের ওষুধশিল্প বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়বে। বর্তমানে পেটেন্ট আইনে ছাড়ের কারণে বাংলাদেশ ওষুধের নিজস্ব চাহিদার ৯৮ শতাংশ নিজেরাই উৎপাদন করছে। তবে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি রাইটস পূর্ণ বাস্তবায়নের ফলে তা ঝুঁকিতে পড়ে যেতে পারে।

দ্বিতীয়ত, এলডিসি উত্তরণের পর বিভিন্ন উন্নয়ন সহায়তা ঋণে রূপান্তর হবে। এছাড়া ঋণের শর্ত সহজ থেকে কঠিন হয়ে উঠবে। যদিও সহযোগিতার ধরনের ওপর নির্ভর করে কিছু অনুদান পেতে পারে বাংলাদেশ। তবে তা কমে আসবে। তৃতীয়ত, এলডিসির রুলস অব অরিজিন হিসেবে যেসব গন্তব্যে বাংলাদেশ পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে বাণিজ্য অগ্রাধিকার পায়, তা বাতিল হয়ে যেতে পারে।

এডিবির প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশের ৭০ শতাংশের বেশি তৈরি পোশাক রপ্তানি বর্তমানে বাণিজ্য অগ্রাধিকার সুবিধা ভোগ করে। এলডিসি উত্তরণ প্রক্রিয়া এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য প্রভাব পড়বে বলে আশঙ্কা তৈরি করছে। বিশেষত বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের ৮৩ শতাংশ তৈরি পোশাক। বাণিজ্য সুবিধা ব্যবহার করে এ খাতটি দ্রুত প্রসার লাভ করে। তবে এলডিসি উত্তরণের পর বাণিজ্য অগ্রাধিকার ন্যূনতম পর্যায়ে পৌঁছাতে পারে। বিভিন্ন দেশে শুল্ক ও বাণিজ্য নীতির কারণে নতুন শুল্কারোপ হতে পারে রপ্তানি পণ্যে। এতে রপ্তানি ১৪ শতাংশ কমে যেতে পারে বলে প্রক্ষেপণ করেছে ডব্লিউটিও।

এদিকে বাংলাদেশ এলডিসি তালিকা থেকে বের হওয়ার পরের বছর অর্থাৎ ২০২৭ সালে ব্যাপক রপ্তানি ক্ষতির মুখে পড়বে বলে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। গত বছর প্রণীত ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৭ সালে রপ্তানির ক্ষতির পরিমাণ সাত বিলিয়ন বা ৭০০ কোটি ডলার দাঁড়াতে পারে।

জিইডির ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাজারসুবিধার আওতায় বাংলাদেশের পণ্য যে দেশে রপ্তানি হয়, সেখানে শূন্য বা ন্যূনতম কিছু কর দিয়ে প্রবেশ করতে হয়। প্রতিবছর যত পণ্য রপ্তানি হয়, এর মধ্যে ইইউর দেশগুলোয় ৭২ শতাংশ অগ্রাধিকারমূলক বাজারসুবিধায় যায়। জিইডির প্রতিবেদনে একটি উদাহরণ দিয়ে বলা হয়েছে, ২০১৮ সালে যদি রপ্তানিতে বাজারসুবিধা না থাকত, তাহলে তৈরি পোশাক খাতে ১০০ থেকে ৪০০ কোটি ডলারের ক্ষতি হতো। ধারণা করা হচ্ছে, ২০২৭ সাল নাগাদ রপ্তানি বাড়বে, পাশাপাশি ডলারের দামও বাড়বে। তখন বাজারসুবিধা উঠে গেলে সব মিলিয়ে ৭০০ কোটি ডলারের রপ্তানি ক্ষতি হতে পারে।