[ অনলাইন ] 01/07/2025 |
 |
|
|
দ্রব্যমূল্যে হাঁসফাঁস মানুষের
|
|
|
ঈদের পর থেকে চালসহ বেশ কিছু নিত্যপণ্যের দাম লাগামহীন। গত এক মাসে সব ধরনের চাল, আলু, দেশি পেঁয়াজ, টমেটো, বেগুন, করলা ও সোনালি মুরগি—এই সাত পণ্যের দাম খুচরা পর্যায়ে সর্বোচ্চ ১৩৩ শতাংশ বেড়েছে। পণ্যের দাম নতুন করে বাড়লেও আয় না বাড়ায় ক্রেতা অসহায়। কিনতে গিয়ে পকেটের বারোটা বেজে যাচ্ছে তাদের।
কোনো কারণ ছাড়াই নতুন করে চালের বাজারে অস্থিরতা শুরু হয়েছে। বিশেষ করে মিনিকেট হিসেবে পরিচিত সরু চালের দাম খুচরায় কেজিতে এক লাফে ৮ থেকে ১০ টাকা বেড়েছে। এটি মূল্যস্ফীতিকে নতুন করে উসকে দেওয়ার ঝুঁকি তৈরি করছে।
মোটা চালের দামও কেজিতে নতুন করে তিন থেকে পাঁচ টাকা বাড়িয়েছেন বিক্রেতারা। এতে ভোক্তাদের মধ্যে অস্বস্তি তৈরি হচ্ছে। বিক্রেতারা বলছেন, গত দুই সপ্তাহে মিল পর্যায়ে মিনিকেট চালের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। এর প্রভাবে খুচরা ও পাইকারিতেও দাম বেড়েছে।
চালকল মালিকদের দাবি, বাজারে মিনিকেট চালের ধানের সংকটের কারণে বাড়তি দাম দিয়ে কিনতে হচ্ছে। উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় চালের দাম বেড়েছে।
বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সরকারের মজুদ নীতিমালার তোয়াক্কা না করে অসাধু মজুদদার ও করপোরেট চাল ব্যবসায়ীরা বেশি পরিমাণে ধান কিনে মজুদ করে রেখেছেন। কৃষকের ধান সাধারণ মিলারদের হাতে নেই বললেই চলে। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে চালের বাজারে। তাঁরা বলছেন, বাজার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের সক্রিয়তা ধারাবাহিক নয়। ভোক্তারা এতে পণ্যের বাজারে প্রত্যাশিত সুবিধা পাচ্ছেন না। বাজারে তদারকি না থাকায় ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে পণ্যের দাম বাড়িয়ে বাজারে অস্থিরতা তৈরি করছেন। এখনই লাগাম টেনে ধরতে না পারলে অস্থিরতা বাড়বে।
অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা বলছেন, আগের তুলনায় সার্বিক মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমলেও বাজারে চাল ও সবজির চড়া দামে স্বল্প আয়ের মানুষ আবার নতুন করে চাপে পড়ছে। যেভাবে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে, মূল্যস্ফীতি আবার বেড়ে যেতে পারে। আয় বৃদ্ধির তুলনায় মূল্যস্ফীতির হার বেশি হলে গরিব ও মধ্যবিত্ত মানুষ সংসার চালাতে ভোগান্তিতে পড়ে। কয়েক অর্থবছর ধরে চলা এই উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে। প্রভাব পড়ছে মানুষের যাপিত জীবনে।
সরকারি বিপণন সংস্থা টিসিবি এবং রাজধানীর খুচরা বাজারের গত ২৯ ও ৩০ জুন এবং ৩০ মের বাজারদর পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, গত এক মাসের ব্যবধানে খুচরায় প্রতি কেজি চিকন চাল (মিনিকেট) ১২ থেকে ১৪ শতাংশ বেড়ে মানভেদে ৮২ থেকে ৯০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। চালের বাজারে সবচেয়ে বেশি চাহিদাসম্পন্ন মোটা চাল ব্রি-২৮এর দাম ৩ থেকে ৭ শতাংশ দাম বেড়ে মানভেদে ৬০ থেকে ৬২ টাকা হয়েছে।
ঈদের পর মাত্র তিন সপ্তাহের ব্যবধানে আলুর দাম কেজিতে ২০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে এখন ৩০ টাকা। দেশি পেঁয়াজ কেজিতে ৯ থেকে ১০ শতাংশ বেড়ে এখন ৫৫ থেকে ৬০ টাকা। টমেটোর মৌসুম শেষ হওয়ায় বাজারে কয়েক গুণ বেড়ে গেছে দাম। মানভেদে প্রতি কেজিতে ১০০ থেকে ১৩৩ শতাংশ পর্যন্ত দাম বেড়ে ১০০ থেকে ১৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
বাজারে সরবরাহ কিছুটা কম থাকায় করলা, বেগুন, বরবটি ও পটোলসহ বেশ কিছু সবজির দাম বেড়েছে। করলার দাম ৩৩ থেকে ৪৩ শতাংশ বেড়ে মানভেদে প্রতি কেজি ৮০ থেকে ১০০ টাকা, বেগুন মানভেদে কেজিতে ২৫ থেকে ৩৩ শতাংশ বেড়ে ৮০ থেকে ১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বরবটি প্রতি কেজি ৮০ থেকে ১০০ টাকা ও ৫০ থেকে ৬০ টাকা। ঈদের পর প্রথম দুই সপ্তাহে মুরগির চাহিদা তেমন না থাকলেও এক সপ্তাহ ধরে চাহিদা বেড়েছে। এতে সোনালি মুরগির দাম বেড়েছে। তবে ব্রয়লার মুরগির দাম বাড়েনি। গত এক মাসে সোনালি মুরগির দাম কেজিতে ১২ থেকে ১৪ শতাংশ বেড়ে মানভেদে ২৮০ থেকে ৩২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ব্রয়লার মুরগি প্রতি কেজি ১৬০ থেকে ১৭০ টাকা।
রাজধানীর রামপুরা কাঁচাবাজারে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত মো. সাদিকুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ঈদের আগে ২৫ কেজির এক বস্তা মিনিকেট চাল কিনেছিলাম এক হাজার ৮৭৫ টাকায়। এখন বাজারে এসে শুনি দাম বেড়ে সেই বস্তা এখন দুই হাজার ১২৫ টাকা। চাল না কিনে উপায় নেই।। এভাবে একটার পর একটা জিনিসের দাম বাড়ায় ব্যয়ের চাপ বাড়ছে। গত দুই-তিন বছরে আমার আয় তেমন না বাড়লেও ব্যয় অনেক বেড়েছে। কাটছাঁট করেও সংসারের খরচ সামলাতে পারছি না।’
কারওয়ান বাজারের মেসার্স মান্নান রাইস এজেন্সির মালিক আব্দুল মান্নান তালুকদার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এই ভরা মৌসুমে চালের দাম বাড়ার কারণ নেই। মিলাররা সিন্ডিকেট করে দাম বাড়িয়েছেন। গত বছরের তুলনায় এ বছর মিনিকেট চাল কেজিতে ১৪ টাকা বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে। এক বছরে মোটা চাল ব্রি-২৮ প্রতি কেজিতে আট টাকা পর্যন্ত বেড়ে বিক্রি হচ্ছে। নাজিরশাইল চালও কেজিতে ১০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। এটা সম্পূর্ণ মিলারদের কারসাজিতে বেড়েছে। তাই সরকারকে এখনই বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে।’ মিল পর্যায়ে নিয়মিত অভিযান চালানোর অনুরোধ জানান তিনি।
কারওয়ান বাজারের মেসার্স ঢাকা রাইস এজেন্সির ব্যবসায়ী মো. সায়েম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এখনো চালের মৌসুম চলছে। অথচ ৫০ কেজির চালের বস্তায় এক লাফে ৪০০ টাকা পর্যন্ত বেড়ে গেল। সাধারণত মৌসুমের শেষদিকে কেজিতে দু-এক টাকা করে দাম বাড়ে। চিকন চাল এক লাফে কেজিতে ৮ টাকা বাড়ার নজির নেই।’
কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম খান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকারকে জোরালো পদক্ষেপ নিতে হবে। সঠিকভাবে বাজার তদারক করতে হবে। মজুদ যারা করেছে, তাদের শনাক্ত করে ব্যবস্থা নিতে হবে। খোলা বাজারে সরকারকে চাল বিক্রির কার্যক্রম চালিয়ে যেতে হবে। চালের বাজারটাকে সরকারের নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। তাহলে চালের বাজার স্বাভাবিক হবে।’ |
|