[ অনলাইন ] 04/07/2025 |
 |
|
|
এনবিআরে অবসর, বরখাস্ত, বদলি ও তদন্ত–আতঙ্ক
|
|
|
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) দেড় মাসের আন্দোলনের পর এখন শুরু হয়েছে বাধ্যতামূলক অবসর, বরখাস্ত, বদলি ও তদন্ত-আতঙ্ক। আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী নিজেদের ফেসবুক পেজ নিষ্ক্রিয় করে ফেলেছেন। অন্যান্য সামাজিক মাধ্যম থেকেও নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছেন। কার্যালয়ে গেলেও কাজকর্মে মন নেই অনেকের।
গত রোববার রাতে আন্দোলন প্রত্যাহার করার পর অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ এনবিআরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ভয়ডরহীনভাবে কাজ করার আহ্বান জানান। কিন্তু বাস্তবে এর প্রতিফলন নেই। চলছে বাধ্যতামূলক অবসর, বরখাস্ত ও বদলি।
গতকাল বৃহস্পতিবারও এনবিআরের দুই কমিশনারসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে তদন্তে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন। দুদক সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে এ তথ্য জানিয়েছে। এই পাঁচ কর্মকর্তা হলেন বেনাপোল কাস্টমস হাউসের কমিশনার মো. কামারুজ্জামান, ঢাকা পূর্ব কাস্টমস এক্সাইজ অ্যান্ড ভ্যাট কমিশনারেটের কমিশনার কাজী মোহাম্মদ জিয়াউদ্দিন, আয়কর বিভাগের অতিরিক্ত কর কমিশনার সেহেলা সিদ্দিকা, উপ-কর কমিশনার মো. মামুন মিয়া ও কর পরিদর্শক লোকমান আহমেদ।
গত পাঁচ দিনে সব মিলিয়ে এনবিআরের ২ জন সদস্যসহ ১৬ জন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে দুদক। তাঁদের অধিকাংশই আন্দোলনের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন। আন্দোলন প্রত্যাহারের পর এ পর্যন্ত তিনজন সদস্য ও একজন কমিশনারকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে। কাজ বন্ধ রাখার দায়ে চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসের কমিশনারকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।
রোববার রাতে আন্দোলন প্রত্যাহারের জন্য ব্যবসায়ী নেতারা সরকার ও আন্দোলনকারীদের মধ্যে মধ্যস্থতা করেন। সূত্রগুলো বলছে, আন্দোলন প্রত্যাহারের পর আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে না, এমন আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল। ব্যবসায়ীরাও সেই আশ্বাসের কথা আন্দোলনকারীদের জানিয়েছিলেন। পরে ব্যবসায়ী নেতা ও আন্দোলনকারী এনবিআর কর্মকর্তাদের যৌথ সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলন প্রত্যাহারের ঘোষণা দেওয়া হয়।
এনবিআরের আন্দোলনে নেতৃত্ব প্রদানকারী কর্মকর্তারা এখন মধ্যস্থতাকারী ব্যবসায়ী নেতাদের এসব শাস্তিমূলক ব্যবস্থা সম্পর্কে অবহিত করছেন। তাঁরা এ ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা বন্ধে উদ্যোগ নেওয়ার দাবি জানান।
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, বিভিন্ন পর্যায়ের আরও কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোর তালিকা করা হচ্ছে। পাশাপাশি বেশ কিছু কর্মকর্তাকে বদলির জন্য পর্যালোচনা করা হচ্ছে। আন্দোলনে সম্পৃক্ত ছিলেন, এমন কর্মকর্তা-কর্মচারীরাই প্রাথমিক তালিকায় আছেন বলে এনবিআরের একাধিক কর্মকর্তা জানান।
রাজস্ব খাতে যৌক্তিক সংস্কারের দাবিতে দেড় মাস ধরে আন্দোলন করে এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ। গত শনি ও রোববার দুই দিন কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচি পালন করা হয়। এতে সারা দেশের রাজস্ব আদায় কার্যক্রম অচল হয়ে যায়।
এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, এনবিআরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়ে সরকার উভয় সংকট অবস্থায়। শৃঙ্খলাভঙ্গের দায়ে সরকারি কর্মচারীদের বিরুদ্ধে যদি ব্যবস্থা না নেওয়া হতো, তাহলে একটি দৃষ্টান্ত তৈরি হতো যে শৃঙ্খলাভঙ্গ করেও পার পাওয়া যায়। আবার যেহেতু একটি সমঝোতা হয়েছিল, তাই এত দ্রুত এ ধরনের শাস্তি না দিয়ে একটু রয়ে-সয়ে করা যেত। তাহলে এনবিআরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে এখন যে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে, তা এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল। যাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হলো
যাঁদের বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে তাঁরা হলেন—এনবিআর সদস্য আলমগীর হোসেন, হোসেন আহমদ ও আবদুর রউফ এবং কমিশনার মো. শব্বির আহমেদ। সদস্য ও কমিশনার হলো রাজস্ব প্রশাসনের এনবিআরের চেয়ারম্যানের পরে দ্বিতীয় ও তৃতীয় সর্বোচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা। আদেশে বলা হয়, তাঁদের চারজনের চাকরিকাল ২৫ বছর পূর্ণ হয়েছে। সরকার জনস্বার্থে তাঁদের সরকারি চাকরি থেকে অবসর প্রদান করে।
আবদুর রউফ ভ্যাট আইন এবং কর কমিশনার শব্বির আহমেদ আয়কর আইন প্রণয়নের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন। তাঁরা এনবিআরের ভ্যাট ও আয়কর আইন ও নীতিবিশেষজ্ঞ হিসেবে বিশেষভাবে পরিচিত।
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, শব্বির আহমেদ ঢাকার কর অঞ্চলের কমিশনারের দায়িত্ব পালন করছিলেন। এনবিআর সংস্কারের বিষয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। কয়েক মাস আগে তাঁকে বরিশাল কর অঞ্চলে বদলি করা হয়। এবারের আন্দোলনের সময় তিনি আন্দোলনকারীদের পক্ষে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশ সোচ্চার ছিলেন।
অন্যদিকে কাজ বন্ধ রাখার দায়ে গত মঙ্গলবার রাতে চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসের কমিশনার জাকির হোসেনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। জানা গেছে, তিনিও আন্দোলনকারীদের সমর্থন করেন এবং মার্চ টু এনবিআর কর্মসূচিতে অংশ নেন।
এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের শীর্ষ এক নেতা প্রথম আলোকে বলেন, আন্দোলন প্রত্যাহারের পর কোনো ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না, এমন আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল ভিন্ন চিত্র। বাধ্যতামূলক অবসর, বরখাস্ত, বদলি—সবই চলছে। সব শ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্যে এখন আতঙ্ক বিরাজ করছে। এ ছাড়া এনবিআরের সংকট নিরসনে সরকার গঠিত পাঁচ সদস্যের উপদেষ্টা কমিটিতেও আন্দোলনকারীদের এখনো ডাকা হয়নি।
এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান গতকাল সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে বলেন, ‘ধীরে ধীরে এনবিআর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসছে। সবাইকে দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে। দিন শেষে সবাইকে রাষ্ট্রের স্বার্থ চিন্তা করতে হবে। বদলি, অবসর—এসব প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এসব সরকারের নীতি সিদ্ধান্ত। সেখানে আমি কিছু বলতে পারি না।’ যেভাবে মধ্যস্থতা হয়
এনবিআর বিলুপ্ত করে রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা—এই দুটি বিভাগ করার জন্য গত ১২ মে অধ্যাদেশ জারি করে সরকার। দুটি বিভাগ করা নিয়ে আন্দোলনকারী এনবিআরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের তেমন একটা আপত্তি নেই। তাঁরা চান, সব পক্ষের মতামতের ভিত্তিতে এনবিআরের যৌক্তিক সংস্কার। এ নিয়ে তাঁরা দেড় মাস ধরে আন্দোলন করেছেন। একপর্যায়ে গত শনি ও রোববার কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচি দেন আন্দোলনকারীরা। এতে সারা দেশের আমদানি রপ্তানি কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়।
এমন অবস্থায় শনিবার সকালে দেশের শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন ব্যবসায়ী সংবাদ সম্মেলনে অচলাবস্থা নিরসনের দাবি করেন। এরপর ব্যবসায়ীরা আন্দোলন প্রত্যাহার করার পাশাপাশি পরিস্থিতি স্বাভাবিক অবস্থায় আনতে মধ্যস্থতা করেন। বৈঠকে উপস্থিত একাধিক ব্যবসায়ী প্রথম আলোকে জানান, আন্দোলন প্রত্যাহার করা হলে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে না বলে আশ্বাস দিয়েছিলেন অর্থ উপদেষ্টা।
এই মধ্যস্থতা প্রক্রিয়ায় ছিলেন প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী আহসান খান চৌধুরী। তিনি গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘অর্থ উপদেষ্টা আশ্বস্ত করেছিলেন আন্দোলন প্রত্যাহার করার পর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে না। কিন্তু তিন দিন ধরে দেখছি, এনবিআর কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুদক অনুসন্ধান করছে, এনবিআর নানা ধরনের শাস্তি দিচ্ছে। অনেককে অবসরে পাঠাচ্ছেন।’ তিনি মনে করেন, ভয়ভীতি না থাকলে এনবিআর কর্মকর্তারা কাজে মনোযোগী হবেন। আমদানি-রপ্তানি প্রক্রিয়াও মসৃণ হবে। |
|